ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নির্বাচন-সহিংসতা-সংখ্যালঘু এবং গণমাধ্যম

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
নির্বাচন-সহিংসতা-সংখ্যালঘু এবং গণমাধ্যম ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

আওয়ামী লীগের কথা না হয় বাদই দিলাম, কারণ তারা তো তাদের কথাটাই বলবেন। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তার স্বভাবসিদ্ধ একটু দৃঢ় মনোভাব নিয়ে বলেছেন, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে গণতন্ত্র শিখতে চাই না।

তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের মিডিয়া অনেক শক্তিশালী। পর্যবেক্ষণের জন্যে বাংলাদেশের মিডিয়াই যথেষ্ট।

তার কথার প্রতিধ্বণি করে আমরাও মনে করি, বাংলাদেশের মিডিয়াই যথেষ্ট। এ কথাটি কি তথ্যমন্ত্রীর ভোটের আগে মনে হয় নি? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার বাজেট, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে পৌনপুনিক বৈঠক শুধু একটাবার নির্বাচনটা দেখে যাবার জন্যে। তা-ও হয়ে ওঠে নি। আমারতো মনে হয় ভালোই হয়েছে। সন্ত্রাস আর ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র তাদের দেখতে হয় নি। অন্তত বিদেশের পত্রিকাগুলোতে সরেজমিন রিপোর্টগুলোতে  এখন আর এসব উঠে আসছে না। বরং বিএনপি-জমায়াতীদের দ্বারা শতাধিক ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দেয়াটা শাপে বর হয়েছে সরকারের জন্যে।

পর্যবেক্ষণ ছাড়াই দেশে-বিদেশে মানুষ জেনেছে কি ভয়ংকর হতে পারে এই গ্রুপ। তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রয়োজনে কি ভয়ংকর হতে পারে এই দেশদ্রোহী চক্র, তা শেষপর্যন্ত তারা প্রমাণ করেছে তাদেরই

কার্যক্রম দিয়ে। যা বলার তা বলা প্রয়োজন। যেমন শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন- ভোট হয় একদিন, কিন্তু স্কুলে শিক্ষা দেয়া হয় অনন্তকাল । অর্থাৎ একদিনের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্যে স্কুলগৃহ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এটা কোন ধরনের

নাশকতা? অনন্তকালের এই মানুষ গড়ার আশ্রয়গুলো যারা জ্বালিয়ে দেয়, তারা আর যা-ই হোক দেশের হিতাকাঙ্খী হতে পারে না।

সত্যগুলো এভাবেই আসছে, শক্তিশালী মিডিয়াই এসব জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। যে পত্রিকাগুলোর নীতিমালায়, এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে যাবার ইচ্ছে নেই তাদের সাংবাদিকরাও কিন্তু ফেসবুক কিংবা সামাজিক

নেটওয়ার্কগুলোতে ৫ জানুয়ারির ভোটকে পর্যবেক্ষণ করে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলেই উল্লেখ করেছে। সুতরাং ইনু সাহেবরা গণতন্ত্রের ছবকের কথা বললেই কি আর না বললেই কি। দেশের মানুষ হত্যা-সন্ত্রাসের বিপক্ষে দাঁড়াবেই। সেজন্যই ইনু সাহেবদের বলি, সত্যের পক্ষে দাঁড়ান।

নির্বাচন হয়েছে। সংবিধান সুরক্ষার প্রয়োজনে একটা নির্বাচন প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়া ফ্যসিস্টদের করায়ত্ত না হতে দিতে এ নির্বাচনের বিকল্প ছিলো না।   কিন্তু নির্বাচন ঘিরে যে উচ্ছ্বাস কিংবা যে গণজাগরণ হবার কথা ছিলো দেশজুড়ে, তার কিছুই হয় নি। জাতীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও নয়। একথার অর্থ এই নয় যে, তারেক রহমান লন্ডন থেকে বললেন আর জনগণ প্রহসনের নির্বাচন বয়কট করে ফেললো।

বরং একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়েছে, খালেদা জিয়া আন্দোলনের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, আর তারেক জিয়া নাশকতার ডাক দিয়ে সার্থক হয়েছেন। তারেক রহমান মনে করেছেন তিনি সার্থক। তাই বলেছেন জনগণ নির্বাচন বয়কট করেছে। নির্বাচনে তার দল আসে নি। না আসতেই পারে। এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মানুষ খুন করে কিংবা স্কুলভবন জ্বালিয়ে দিয়ে, সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়ে, বোমাবাজী করে, পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে কোন্ গণতন্ত্র দেখেন তারা? বয়কটের কি আরেক অর্থ হত্যা করো-জ্বালাও এবং জ্বালো। যদি এটা হয়, তাহলে তারেক রহমানের ডাক সার্থক।   সারা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করলে মানুষ ঘর থেকেই তো বের হবে না। ভোট দেয়াতো দূরের কথা। ডাকাত-খুনিদের ভয়তো মানুষই করে।

তবুও যারা বেরিয়ে এসেছিলো, তারা সন্ত্রস্ত থেকেছে। সে হিসেবে তারেক রহমান কিংবা খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জোট আন্দোলনের মাঠে সার্থক না হলেও অগ্নি সংযোগ-হত্যা, সংখ্যালঘুদের বাড়ি লুট প্রভৃতি নাশকতায় ঠিকই ক্যারিশমা দেখিয়েছে।   সন্ত্রাস কে সম্বল করতেই হয়েছে তাদের। এবং তারা সার্থকও। ভোটপ্রদান বলি কিংবা বিরোধী পক্ষের নাশকতা বলি, একটা জ্বলন্ত উত্তপ্ত বাংলাদেশের চিত্র আমাদের কাছে পৌছে দিতে একমাত্র মাধ্যমই ছিলো গণমাধ্যম। রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতিতে মানুষ আস্থা রাখে নি, এখনও রাখছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই পর্যবেক্ষণ কিংবা ছাড়পত্রতো এসেছে এই শক্তিশালী মিডিয়াগুলো থেকেই। মিডিয়াগুলোই দেখাতে পারছে ভোটের চিত্র, আবার মিডিয়াগুলোই জানাতে পারছে ওই আগুন-সন্ত্রাসের বহ্নিশিখার লেলিহান সংবাদ। সুতরাং বিদেশিদের পর্যবেক্ষকদের টানতে কেন-ই-বা এই ব্যর্থ আয়োজন?

২) নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা মিডিয়ার কল্যাণে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারেক রহমানসহ তার দলের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, কি সুখ তারা পান নিরীহ মানুষগুলোর উপর নির্যাতন চালিয়ে। না-কি তাদের সহিংস পাশবিক বৃত্তিটুকুর বহিপ্রকাশের জায়গাটাই হলো এ সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়! আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, যে দল কিংবা যে কথিত রাজনৈতিক কর্মীরা নিরীহ মানুষের ঘর পোড়ায়, পরিকল্পিতভাবে মানুষ পোড়ায় তারা আবার রাজনীতিবিদ হয় কিভাবে? আর কোন্ আদর্শ নিয়ে তারা জনগণের সামনে দাঁড়ায় ? আমার এলকার এক হিন্দু শিক্ষক (হিন্দু শব্দটাই লিখলাম) তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রশ্ন করেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকার তোমার প্রশাসন কোথায়? তোমাদের ডাকে সাড়া দিতে গিয়েই তো আজ হিন্দুরা এই ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে। জনগণকে রক্ষা করবার ক্ষমতা না থাকলে ক্ষমতা দখল করে লাভ কি?’’ সত্যি কি মিথ্যা জানি না। ক্ষমতা দখল হয়েছে কি-না সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না, তবে এটা জানি এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ বরাবরের মতোই একটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি।

সরকারকে দৃঢ় হতেই হবে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা অবশ্যই দিতে হবে এই বাঙালিদের। আমার আরেক বন্ধু লিখেছেন,‘‘ চিন্তার কিছু নাই এমন দিন খুব বেশি দূরে নয়, যখন বাংলাদেশে আর সংখ্যালঘু শব্দটি থাকবে না, কারন হিন্দু নামের এই প্রজাতিটিই আর থাকবে না। বাংলার আগামী প্রজন্ম তাদের কথা পড়বে রুপ কথায় অথবা ইতিহাসে, আমরা যেমন পড়ি বিলুপ্ত কোন মানব প্রজাতির কথা। ’’ জানি ক্ষোভের উচ্চারণ এটি। এর বাস্তবতা হয়ত ভিন্ন। কিন্তু এর মাঝে সত্যের ছোঁয়া যে আছে, তা অস্বীকার করি কিভাবে। সরকার যদি এই মানুষগুলোর জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে না পারে, তবে জামায়াত জাতীয় প্রজাতির কাছে তারা কিভাবে নিরাপদ থাকবে।

এরা বাঙালি, এরা বাংলাদেশের নাগরিক। মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষগুলোও প্রাণপন লড়েছে। যারা ওদের মারছে, পুড়াচ্ছে বাড়ি-ঘর, এরাই বরং দেশদ্রোহী। আমাকে বলতেই হয় একাত্তরের খাটি প্রেতাত্মা এরাই।   সুতরাং কঠোর হতেই হবে সরকারকে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শব্দগুলো জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক সার্থসিদ্ধি নয়, মানবসভ্যতার বিকাশে বাঙালি জাতির অপরিহার্য এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে থাকতে হবে সাধারন মুসলমানদেরও। সরকারের দায়িত্বের পাশাপাশি জনগণকে এ দায়িত্বটুকু নিতেই হবে। প্রয়োজনে মানব বর্ম তৈরি করে মানবিক এই দায়টুকু পালন করতে হবে আমাদের।

৩) সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। দোহারে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় মারা গেছে ৫ জন। প্রতিহিংসার দা’র কোপে এই মানুষগুলো মরে গেলো। আরও মৃত্যুর খবর আসছে। প্রতিহিংসা ছড়িয়ে পড়বে। সুযোগ নেবে সেই পরাজিত শক্তি। পরাজিত শক্তি রোখার অঙ্গিকার নিয়েছে আজকের সরকার। শত বাধা-বিপত্তি, আন্তর্জাতিক চাপ .... চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে একের পর এক। তবুও এগুতে হবে। সমাজ আর রাজনীতিতে শৃংখলা বড় বেশি প্রয়োজন এখন। অর্থনীতি থমকে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দেশ। পথ করে দিতে হবে সরকারকেই। হয়ত আরেক নির্বাচনের পথ ধরে এগুতে হবে আবারও। একটা সন্ত্রাসের রাজত্বে আমরা বাস করতে পারি না।

ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক, faruk.joshi@googlemail.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।