ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪
তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রার্থনা ছবি: (ফাইল ফটো: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

খুব সহজে আমার মন খারাপ হয় না। কিন্তু গত কয়েকদিন থেকে আমার খুব মন খারাপ।

যারা এক নজর পত্রিকার দিকে তাকাবে কিংবা টেলিভিশনে খবর শুনবে তাদেরও মন খারাপ হয়ে যাবে। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে এই দেশে মানুষের ঘর বাড়ী পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে আতংকে জীবন বাঁচাবার জন্য এই মানুষগুলো নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। বাড়ির মেয়েদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।

১৯৭১ সালে হিন্দু মুসলমান সবাই আক্রান্ত হয়েছিল। মুসলমান হলে কখনো কখনো মানুষ বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু হিন্দু হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে কেউ কখনো প্রাণে বেঁচে আসতে পারেনি।

১৯৭১ সালে আমরা গ্রামে লুকিয়ে আছি, তখন দেখেছি একজন হিন্দু মা তার শিশু সন্তানকে বুকে চেপে ধরে স্বামীর পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে, তাদের চোখে মুখের সেই উদভ্রান্ত অসহায় দৃষ্টি আমি কখনো ভুলতে পারবো না। তেতাল্লিশ বছর পর এই বাংলাদেশে কখনো একজন অসহায় হিন্দু মা তার সন্তানকে বুকে চেপে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছে। তার মানে, যে দেশকে নিয়ে আমরা এতো গর্ব করি সেই দেশটি আসলে তেতাল্লিশ বছরে এক ইঞ্চিও অগ্রসর হয়নি। এর চাইতে বড় দুঃখ লজ্জা আর অপমান কী হতে পারে?

আমি মাঝে মাঝে কল্পনা করি, আমি যদি এইদেশে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে আমার কেমন লাগতো। আমি জানি তাহলে গভীর হতাশায় আমার বুক ভেঙ্গে যেতো, আমি কোনো দোষ করিনি কিন্তু শুধু একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলে আমার উপর যে নৃশংস অত্যাচার করা হচ্ছে তার জন্যে আমার বুকে যেটুকু ক্ষোভ জন্ম নিতো, তার চাইতে শতগুণ বেশি অভিমান হতো আমার চারপাশের নির্লিপ্ত মানুষজনকে দেখে।

কেউ কোনো কথা বলছে না, নীরবে এক ধরনের করুণা নিয়ে আমাকে দেখছে। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ হতো রাজনৈতিক দলগুলোর উপর, প্রতিবার নির্বাচনের পর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হবার পর আমাদের উপর হামলা করা হবে। বিএনপি‍ জামায়াত হামলা করবে, আওয়ামী লীগ বা বামদলগুলো সেটা ঘটতে দেবে। খুব বেশি হলে নিরাপদ দূরত্ব থেকে প্রতিবাদ করবে, কিন্তু বুক আগলে কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। এই দেশে আমি যদি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমার বারবার মনে হতো আমি এই দেশের মানুষ। কিন্তু এই দেশটি আমাকে রক্ষা করছে না।

আমি নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে বলতাম, তুমি কেন আমাকে এমন একটি দেশে জন্ম দিয়েছ যেই দেশ আমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় না? যেই দেশে আমাকে প্রতি মুহূর্তে আতংকে থাকতে হয়?

কিন্তু আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী নই, তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের বুকের ভেতর যে গভীর দুঃখ ক্ষোভ হতাশা আর অভিমান পুঞ্জিভূত হয়ে আছে, আমি সেটা কোনোদিন অনুভব করতে পারব না।

আমাদের প্রিয় দেশটি নিয়ে আমাদের কত কল্পনা, কতো স্বপ্ন। আমরা আশা করে আছি আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে, জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে।   একদিন এই দেশটা মাথা তুলে দাঁড়াবে। আমরা এর মাঝে সেগুলো এই শুরু হতে দেখেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কাছে সবকিছু অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। যদি আমরা একজন মানুষকে শুধু ভিন্ন ধর্মাবলী হওয়ার জন্য এই দেশে নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে এই দেশ কাদের জন্য? আমার মনে হয় এই দেশ নিয়ে আমাদের যত কল্পনা, যত স্বপ্ন, যত পরিকল্পনা সবকিছু পেছনে সরিয়ে সবার আশা, আমাদের এখন একটি লক্ষকে টেনে নিয়ে আসতে হবে। সেই লক্ষটি হচ্ছে এই দেশে প্রতিটি হিন্দু শিশু যেন নিরাপত্তায় তার মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারে। গভীর রাতে ধর্মান্ধ মানুষের উন্মত্ত চিৎকারে তাদের জেগে উঠতে না হয়, আগুনের লেলিহান শিখায় আপনজনের আতঙ্কিত মুখ দেখতে না হয়। একজন হিন্দু কিশোরীকে যেন তার বাবার রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলতে না হয়, ‘এখন কি হবে বাবা?’

আমরা পদ্মা সেতু চাই না, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ চাই না, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ চাই না, শতকরা একশভাগ নিরক্ষর চাই না, ক্ষুধা মুক্ত বাংলাদেশ চাই না, শুধু হিন্দু এবং অন্য সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা চাই, যেন তারাও ঠিক আমাদের মত এই দেশটিকে তাদের নিজেদের ভালোবাসার দেশ বলে ভাবতে পারে। তীব্র অভিমানে তাদের বুক ভেঙ্গে যেন আর কোনোদিন খান খান হয়ে না যায়।

আমি কার কাছে এটি চাইব জানি না। তাই তরুণ প্র্রজম্মের কাছে চাইছি তোমরা আমাদের একটি নতুন বাংলাদেশ উপহার দাও। বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ‍বিষ বাষ্প চিরদিনের জন্য মুছে দেওয়া হবে। আমি জানি তোমরা পারবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।