ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এক দুই এবং তিন

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৪
এক দুই এবং তিন

১.
আমার ধারণা গত কয়েক সপ্তাহে এদেশের সব মানুষের বিশাল একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্যদের কথা জানি না, অনেক বিষয়েই আমার নিজেরই চোখ খুলে গেছে।

যে বিষয়গুলো আগে আলাদা করে চোখে পড়েনি আজকাল তার অনেক কিছুই চোখে পড়তে শুরু করেছে।

তবে, রাজনীতি এখনো আমার কাছে অনেক জটিল বিষয়, অনেক কিছুই কমনসেন্সে মেলে না, তাই সবকিছু বুঝতে পারি না। তারপরেও আমি এই জটিল এবং দুর্বোধ্য বিষয়টাকে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমি মাত্র তিনটি মাপকাঠি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিজের কাছে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কাছে মাপকাঠিগুলো এরকম:

প্রথমটি অবশ্যই বাংলাদেশকে নিয়ে। আজকাল মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় অনেকেই বুঝি বাংলাদেশের আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছেন। অনেকের ধারণা গাছে পেকে যাবার পর আম যেভাবে টুপ করে নিচে এসে পড়ে, বাংলাদেশটাও বুঝি সেভাবে তাদের হাতে এসে পড়েছে।

তাই মানুষ যেভাবে আম খায় তারাও বুঝি সেভাবে কেটে কেটে ঝাল মরিচ দিয়ে কিংবা চটকে চটকে দুধ দিয়ে কিংবা চিপে চিপে রস বের করে শুকিয়ে আমসত্ব বানিয়ে খেতে পারবে। ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। বাংলাদেশটা আমরা পেয়েছি রীতিমত একটা যুদ্ধ করে। আর সেটাও রাজায় রাজায় যুদ্ধ ছিল না, সেটা ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এ দেশের মানুষরা যেভাবে প্রাণ দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই।

তাই যারা প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে এদেশটা এনে দিয়েছে তারা যে স্বপ্ন দেখেছিল সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এ দেশের রাজনীতি হোক, অর্থনীতি হোক, লেখাপড়া হোক কোনো কিছুই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাইরে হতে পারবে না। অর্থাৎ, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যারা এটিকে অস্বীকার করে তাদের এদেশে রাজনীতি করা দূরে থাক, এই দেশের মাটিতে পা রাখার অধিকার নেই।

অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বুকের ভেতরে এক ধরনের তীব্র আবেগ রয়েছে। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে এটা শুধুমাত্র একটা অর্থহীন আবেগ। আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যতটুকুও রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো তখনই এই দেশটিকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিলো। এখন বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না।

পাশের দেশ ভারত এখন সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্কা দেবার সাহস রাখে, অমর্ত্য সেন সেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেছেন, আমরা অনেক দিক দিয়ে ভারত থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশের সাফল্যের রহস্যটি বোঝার জন্য রীতিমত একাডেমিক গবেষণা করা হয়। আর সেই গবেষণার ফলাফল আমাদের কাছে অবাক করা বিষয় নয়। আমরা সেটা বহুদিন থেকেই জানি। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা আত্মবিশ্বাসী একটি জাতির পরিচয়, অন্যটি হচ্ছে হাজার বছর থেকে ঘরের ভেতর আটকে রাখা মেয়েদের ঘরের বাইরে এসে সবার সঙ্গে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ।

কেউ কি লক্ষ্য করেছে, জামায়াত ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের প্রধান এলার্জি ঠিক এই দুটি বিষয়ে? যে দুটি শক্তি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব ঠিক সে দুটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা আমাদের পেছনে ফেলে দিতে চায়?

কেউ যেনো মনে না করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, আদর্শ, চেতনা এই বিষয়গুলো শুধু একধরনের আবেগ এবং মোটামুটি একটা বিমূর্ত বিষয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুলো অনেক যত্নকরে তুলে ধরা হয়েছিলো। কারো যদি কৌতূহল হয় তাহলে তারা বাহাত্তরের সংবিধানটি পড়ে দেখতে পারে। একটু একটু করে যখন সেই সংবিধানের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, প্রতিবার আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি আবার আমরা একদিন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।

তাই যখন আমরা শুনতে পাই কেউ ঘোষণা করছে বাহাত্তরের সংবিধানে এই দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি তখন আমি অবাক হয়ে যাই। না, মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হই না, আবার অবাক হই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা দেখে। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কখনো রাজনীতি করতে পারবেন না। কেউ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে তাহলে বুঝতে হবে এই মানুষটির আর যে ক্ষমতাই থাকুক বাংলাদেশের মানুষকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে তার রাজনৈতিক দলের সম্পাদ নয়, তার দলের বোঝা, তার দলের জঞ্জাল।

গত কয়েক সপ্তাহে আমি যেসব বিষয় জানতে পেরেছি তার একটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ- সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতি কিছু বিদেশি কূটনীতিকদের অসম্মানজনক ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি একদিন বিদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে চলে এসেছিলাম। এখন সেই আমার দেশেই আমার বিদেশি কূটনীতিদের অপমান সহ্য করতে হয়। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না যে তাদের একটা দল বিজয় দিবসে আমাদের স্মৃতিসৌধে যায়নি।

আমি যতদূর জানি আমাদের বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের সাহায্যের উপর সেভাবে নির্ভর করে না। এখনো এদেশে নিশ্চিয়ই অনেক টাকা পয়সা আসে এবং সেগুলো আসে বিভিন্ন এনজিওদের কাছে। আমি এরকম একটা এনজিও’র বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের একজন সদস্য হিসেবে তাদের বড় কর্মকর্তার বেতন ঠিক করে দিয়েছিলাম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর হিসেবে আমি তখন যত বেতন পাই সেই বেতনটি ছিল তার চার এবং পাঁচগুণ। কাজেই এনজিও’র কর্মকর্তারা নিশ্চিয়ই ভালোই থাকেন এবং যে দেশ থেকে তাদের বেতন ভাতা আসে সে দেশের এজেন্ডাগুলো নিশ্চয়ই সোজাসুজি কিংবা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়নের একটা চাপ থাকে। তাই তারা তাদের নিরার্ধারিত কাজ ছাড়াও বাড়তি বাজ করেন। এই দেশের মানুষকে ফ্রি উপদেশ দেন।

সেটি সমস্যা নয়। আমরা সবাই উপদেশ দিতে পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দেশটিকে ভয়ংকর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত। মানুষকে প‍ুড়িয়ে মারার হোলি উৎসব চলবে। রেল লাইন তুলে ফেলে ট্রেনকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা কেটে ফেলা হচ্ছে। পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। আমাদের এনজিও কর্মকর্তারা এই ভয়ংকর সস্ত্রাস বন্ধ করার কথা বললেন না। তারা সরকারকে নির্বাচন বন্ধ করার উপদেশ দিলেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্য এদেশে ভয়ংকর সন্ত্রাস চলছিল। তাই প্রকারান্তরে তারা সন্ত্রাসের পক্ষ নিলেন।

এই ব্যপারটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি জানি আমাদের দেশের এনজিওগুলো অসাধারণ কাজ করে। আমি তাদের অনেকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসদের সদস্য। তারা মাঝে মাঝে আমাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। আমার কাছে যখন সেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমি তখন লিখি। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে বিদেশিদের টাকা দিয়ে চলছে এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে আমার সম্পর্কটা কেটে ফেলার সময় হয়েছে।

আমার শ্রমটুক হয়তো দেয়া উচিত দীনহীন দুর্বল প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবকদের, যারা নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ধুকে ধুকে চলছে। তারা যতই দুর্বল হোক তার আমার দেশের প্রতিষ্ঠান। যারা আমার দেশকে আপমান করে তাদের কাছ থেকে তারা কোনো টাকা নেয় না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই এক ধরনের গৌরব আছে।

এই দেশের রাজনীতিতে আমার চওয়া খুবই কম। যে দলটি দেশ চালবে সে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাসী। একই সাথে যে দলটি বিরোধীদল হিসেবে থাকবে সেটিও হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। শুধু এই বিষয়টা নিশ্চত করতে পারলে দেষের সব মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতো। সরকার পরিবর্তন হলেও যারা মনে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা থাকবে না। একটি ভিন্ন দল দেশকে চালানোর জন্য দায়িত্ব পাবে কিন্তু দেশ অগ্রসর হবে একই গতিতে।

 অর্থাৎ, বাংলাদেশে রাজনী‍তির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে যে বিশ্বাস করে না তার এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। দ্বিতীয় মাপকাঠিটি নিয়ে আমার ভেতর বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষজনের নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গিকার।

গত কয়েকদিন এই হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে আঘাত নেমে এসেছে তার চাইতে লজ্জা এবং অপমানের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি তাই এদেশে আমার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আছে। আমার তো একটি হিন্দু পরিবারেও জন্ম হতে পারতো। আমি কোথায় জন্ম নেব, সেখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই।

একটি শিশু ঘটনাক্রমে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে বলে তার জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না আমরা কেমন করে সেটি ঘটতে দিলাম? খবরের কাগজ যখন একজন ভীত মায়ের কোলে একজন শিশুর অসহায় মুখটি দেখি আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হয় এর জন্য নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আমরাই দায়ী।

যারা এটি করে তাদের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে আমার জানা নেই। এর মাঝে শুধু যে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আছে তা নয়। একটা হিন্দু পরিবারকে কোনোভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করতে পারলে জায়গাটা দখল করে নেয়ার সুযোগ আছে। সেই ব্যাপারটিতে শুধু জামায়াত-বিএনপি আছে তা নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে।

পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝে নেতাদের সাথে সাথে তাদের ছবি ছাপা হয়। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি দেয়া না হয় কিংবা যতক্ষণ পর্যন্ত এরকম ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে সেই বিষয়টা নিশ্চিত করা হয়, এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষরা আমাদের ক্ষমা করবে না। শুধু পুলিশ ৠাব দিয়ে বাড়ি পাহারা দিয়ে তাদের রক্ষা করার পরিকল্পনা করা যথেষ্ট নয়। আসলে সেই এলাকার মানুষজনকেও দায়িত্ব নিতে হবে। আগে একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠন এগুলো করতো। এখন সেটা আর ঘটতে দেখি না। এখন আমরা ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটতে দিই তারপর সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় শহরে মানববন্ধন, একটা সেমিনার করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলি।

আমাদের আরো এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা ভাবনারও পরিবর্তন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ কী ভাবছে সেটা বোঝার জন্য তার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে হতো। এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো হওয়ার কারণে কাজটা সহজ হয়েছে, কে কী ভাবছে সেটা নেটওয়ার্কে তাদের কথাবার্তা মন্তব্য দেখে বোঝা যায়। আমরা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছি আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষিত মার্জিত রুচিশীল অনেক মানুষের ভেতরটাও আসলে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ভাবনা দিয়ে অন্ধকার হয়ে আছে।

১৯৭১ সালের একটা ঘটনার কথা আমার মনে আছে। একটা অসহায় হিন্দু পরিবার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছে, আমার মা তাদের একটু অর্থ সাহায্য করার চেষ্টা করলেন। আমরা যে পরিবারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি তাদের একজন আমার মাকে বললো, ‘বিধর্মী মানুষকে সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হবে না। যদি সাহায্য করতেই চান তাহলে একজন বিপদগ্রস্ত মুসলমানকে সাহায্য করেন!’ শুনে শুধু আমার মা নয়, আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম!

সেই তেতাল্লিশ বছর আগের এই দেশের কিছু কিছু মানুষের চিন্তা ভাবনার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়তো নিজে নিজে কোনো কিছুর পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হয়। আমাদের দেশে যেন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বাড়তে না থাকে সেজন্য আমাদের হয়তো দীর্ঘ সময়ের একটা পরিকল্পনা করতে হবে। স্কুলের বাচ্চাদের জীবনটা শুরু করতে হবে সব ধর্মের জন্য ভালোবাসার কথা শুনে। শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের হয়তো বলতে হবে মানুষের কথা, মানুষে মানুষে যে কোনো ভেদাভেদ নেই সেই সত্যটির কথা। টেলিভিশনে নাটক লিখতে হবে, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে, সবচেয়ে বড় কথা একজন মানুষ নিজে অসাম্প্রদায়িক হলেই চলবে না, দায়িত্ব নিতে হবে তার আশেপাশে যারা আছে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতার সৌন্দর্যটুকু বোঝানোর।

তাই আমি এখন অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দেওয়া, যেন তারাও এই দেশটিকে তাদের নিজের দেশ বলে ভাবতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশ না হলে ক্ষতি নেই, পদ্মা সেতু না হলেও ক্ষতি নেই, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ না হলেও ক্ষতি নেই, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রবাহ না হলেও ক্ষতি নেই যদি এই সরকার (কিংবা অন্য যেকোনো সরকার) এদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বী সব মানুষকে একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দিতে পারে।

আমার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশ্বাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গিকারের পর তৃতীয় মাপকাঠিটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম নৈতিকতা। যে মানুষটি রাজনীতি করবে তাকে সৎ হতে হবে এবং এর মাঝে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

এবার নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন। পত্র-পত্রিকাগুলো তাদের নিজেদের দেওয়া হিসাবগুলোই হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছিল। আর সেটা নিয়ে শুধু সারা দেশ নয়, সামাজিক নেটওয়ার্কের কল্যাণে সারা পৃথিবীতেই বিশাল একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

যারা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা প্রথম তথ্যগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারপর নানাভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সাধারণ মানুষ বুঝতে ভুল করে না। সবচেয়ে বড় কথা যাদের সবাই সৎ মানুষ বলে জানে তাদের সম্পদতো হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি। তাদের কিছু ব্যাখ্যাও করতে হয়নি। তাই আসলে কি ঘটেছে তা সবাই বুঝে গেছে।

কিছুদিন আগে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও নির্বাচিত হতে পারে নি। এটাকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফরমুলা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও সত্যি কথাটি হচ্ছে-সাধারণ মানুষও তাদের ভোট দেয়নি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ-এরকম ব্যাপারগুলোতে সরকার যথেষ্ট ভালো কাজ করলেও কেন তাদের কেউ ভোট দিল না সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল। আমার কোনো গোপন সূত্র নেই। কিন্তু পরিচিত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটিভাবে বোঝা গেছে সাধারণ মানুষ তাদের আশেপাশে যেসব ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দেখেছে দৈনন্দিন জীবনে তাদের কারণে যেসব হেনস্তা সহ্য করতে হয়েছে, দুর্নীতি চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে, সেগুলো তাদের মনকে বিকিয়ে দিয়েছে। একশটা পদ্মা সেতু, এক হাজারটা হলমার্ক কেলেঙ্কারি আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করতো একটি বিশ্বজিৎ হত্যা তার থেকে বেশি ক্ষতি করেছে।

কোনো কিছুই গ্রহণ যোগ্য নয়। যারা রাজনীতি করে তাদের সৎ হতেই হবে। এটি নত‍ুন পৃথিবী, কোনো কিছুই আর গোপন থাকে না। কে দুর্নীতিবাজ, কে সন্ত্রাসী, কে গডফাদার সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথীবিতে জানাজানি হয়ে যায়। কাজেই আমাদের আগামী বাংলাদেশে আমরা আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা দেখতে চাই না।

২.
আমি কী চাই সেটা আমি নিজেকে বলতে পারি, যার‍া আমার ‍পরিচিত তাদের বলতে পারি। যারা আমার কথা শুনতে চায় তাদের জোর করে শোনাতে পারি। কিন্তু যাদের কাছে আমরা সেটা চাই সেই রাজনীতিবিদরা কী আম‍াদের সেটা দেবে? তারা কী আমাদের চাওয়া পাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়?

দেওয়ার কথা নয়। ভুল হোক, শ‍ুদ্ধ হোক তাদের অনেক আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর সাথে স‍াথে বাংলাদেশও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পৌঁছেছে। আমরা দিল্লির নির্বাচনে দেখেছি ‘আম আদমি পার্টি’ নামে একট‍া তরুণদের রাজনৈতিক দল সব হিসেব ওলট পালট করে ক্ষমতায় চলে এসেছে। যেহেত‍ু বাংলাদেশে বিশাল একটা তরুণের দল আছে। অনেক হিসেবে তারা ভারতবর্ষের তরুণদের থেকে বেশি রাজনীতি সচেতন, তাই আমরা চাইলেও কী এদেশের রাজনীতির জগতেও একটা ওলট পালট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে না?

আমাদের মতো এতো কষ্টের এতো ভালবাসার দেশকে আমরা যেভাবে চাই যদি সেভাবে গড়ে তোলা না হয়, তাহলে কী এই দেশেও নতুন একটা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে না? যার চালকা হবে নতুন প্রজন্ম। আগামী এক দুই পাঁচ বছরে না হোক তারপরেও কী হতে পারে না? তাদের তো হারানোর কিছু নেই, দেওয়ার অনেক কিছু আছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৪
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।