ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একতরফা পানি প্রত্যাহার রীতি নয় –আইনুন নিশাত

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪
একতরফা পানি প্রত্যাহার রীতি নয় –আইনুন নিশাত আইনুন নিশাত

ড. আইনুন নিশাত পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বর্তমানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য।

এর আগে তিনি ছিলেন আইইউসিএন-বাংলাদেশ প্রতিনিধি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরোকৌশলে ব্যাচেলর ও পানি সম্পদ প্রকৌশলে মাস্টার্স করে, ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন পুরকৌশলে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ জলবায়ূ পরিবর্তন সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলাপ হয় তাঁর সঙ্গে। ’বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর’-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এরশাদুল আলম প্রিন্স

একতরফা পানি প্রত্যাহারে ভাটির তিস্তা আজ পানিশূন্য। আমরা কি পানি পাবো না?
আইনুন নিশাত: তিস্তায় যেটুকু পানি আছে, তা প্রকৃতঅর্থে দুই দেশের চাহিদা মেটাতে অপ্রতুল। তাই ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করছে। মূলত পশ্চিমবঙ্গ তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কিন্তু ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। সমঝোতার ভিত্তিতেই যৌথ-নদীর পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও প্রবাহ পথে ডাম্প স্থাপনের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ। ভাটির পুরোটা অর্থাৎ আমাদের উত্তরবঙ্গের কৃষি ও সেচ ক্ষতিগ্রস্ত, সেই সঙ্গে মরুকরণ।
আইনুন নিশাত: নদী তো মানুষই শুকিয়ে ফেলছে। নদী তো আর আপনাআপনি শুকিয়ে যাচ্ছে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের নদীর যত্ন করছি না। শুধু প্রকৃতির ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই।

তিস্তা একটি অভিন্ন নদী। ইচ্ছা করলেই ভারত তো এখানে বাঁধ দিতে পারে না। ১৯৫৮ সালের নদী আইনটি তো ভারত মেনে চলতে পারে।
আইনুন নিশাত: আন্তর্জাতিক নদী আইন কী আছে? একটি কনভেনশন আছে, তার মানে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো আইন নেই। থাকলেও আমরা কেউ মানছি না। বৈশ্বিকপর্যায়ে যেটিকে আমরা আইন বলছি, তা তো আইন না, কনভেনশন। কিন্তু বাংলাদেশ তো এখনো তা মানে নাই।

ভারতে একাধিক রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর প্রশ্নে রাজ্যগুলো কীভাবে সমাধান করে? তিস্তা প্রশ্নে ভারতের মনোভাবের পরিবর্তন কীভাবে হতে পারে?
আইনুন নিশাত: ভারতের একরাজ্য তো আরেক রাজ্যের বিরুদ্ধে নদীর প্রশ্নে গণঅনশন বা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যায়। তাই অন্য রাজ্যের ক্ষতি না করে নদীর পানি ব্যবহার করতে রাজ্যগুলো বাধ্য হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে কথা, আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রেও সেই কথা। অন্য রাষ্ট্রের ক্ষতি না করাই স্বীকৃত রীতি। যদিও ভারত সেটা করছে না।  
সমঝোতাতেই সমাধান। সক্রিয় ও ফলপ্রসূ কূটনৈতিক প্রক্রিয়া চালাতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে তৃতীয়পক্ষের অন্তর্ভূক্তিও বিষয়টিকে সমাধানের পথে নিতে পারে। ভারতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আর্ন্তজাতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি উত্থাপন করতে হবে। কেবল তিস্তা নয়, অভিন্ন সব নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সামগ্রিক পর্যালোচনার সুযোগ আছে।  

এক্ষেত্রে উজানের দেশ কি তাদের ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহার করতে পারে?
আইনুন নিশাত: ভারতের যদি কী উচিত কী উচিত নয়, সে নীতিবোধের ওপর  নির্ভর করতো এবং পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ যদি নীতি মেনে চলতো তাহলে বিষয়টি অন্য রকম হতো। পৃথিবীর সব নদীই তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতো।   কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে পানির অখণ্ডতা সব রাষ্ট্রের অধিকার। আর এ  অখণ্ডতা রক্ষা করা অন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে।
যৌথ দরকষাকষিতে আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতও আমাদের ওপর নানা বিষয়ে নির্ভরশীল। পানি বা তিস্তা প্রশ্নে আমাদের ভারতের সেই দূর্বলতা বা নির্ভরশীলতার বিষয়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এটাই নেগোসিয়েসন। রাইন নদীর ক্ষেত্রেও একই কূটনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। সরকারের শক্তিশালী ভূমিকা জরুরি। তিস্তা এদেশের মানুষের অধিকার। জনগণ এর অংশীদার। কাজেই সরকার জনগণের শক্তিতেই কাজ করবে। তিস্তা প্রশ্নে জনগণের বিভক্তির কোনো সুযোগ নেই।

লংমার্চের পর তিস্তার পানি বেড়েছে। বিষয়টি কি তাই?
আইনুন নিশাত: এটা আমি গণমাধ্যমে পড়েছি। আমাদের এখানে প্রথম লংমার্চ করেছে বামপন্থীরা। ভারতীয়রা বোকা না। তারা গত চল্লিশ বছরে একবারই ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভাসানির লংমার্চের সময়। তখন ভারতীয় সরকার বিশ্বাস করেছিল যে ভাসানি নদী পার হয়ে এসে ফারাক্কা ভাঙবে। নদীর ওই পারে তারা কামান, ইনফেন্ট্রি তৈরি করে রেখেছিল। তারা ঠিকই বুঝেছিল যে, ওই বুড়োর পেছনে জনগণ আছে। তার মানে জাতীয় ঐক্যই বড় বিষয়।

চুক্তির বিষয়ে জোড় দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে চুক্তি হলেই কি এর সমাধান মিলবে?
আইনুন নিশাত: আমরা যেটা জেনেছি গণমাধ্যমে এবং দুই রাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত প্রেস রিলিজের মাধ্যমে, তা হলআ, দুই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তিস্তার পানি কীভাবে বন্টন হবে, সে চুক্তির খসড়া চুড়ান্ত করা হয়েছে। এখন বাকি আছে চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি। এ কাজটি করবে দিল্লী ও ঢাকা সরকার। দিল্লী সরকারের যদি কোনো অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে, তার দায়িত্ব দিল্লী সরকারেরই। আমরা যেটুকু জেনেছি যে পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু ঝামেলা আছে— সেটা মেটানোর দায় ও তা মিটিয়ে পাওনা পানি ঢাকাকে দেওয়া বা শোধ করার দায় দিল্লীর বা ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের। তাছাড়া চুক্তিতে পানির যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে।  

চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান কী?
আইনুন নিশাত: যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি হলে যতটুকু ন্যায্য বা যৌক্তিক পাওনা তার কাছাকাছি পরিমাণ পানি বাংলাদেশের যৌক্তিক দাবী। পরে চুক্তি হলে সেটা সমন্বয় করতে হয়। এটাই প্রচলিত রীতি। একতরফা পানি প্রত্যাহার রীতি নয়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত গঙ্গার ক্ষেত্রেও ভারত তাই করেছিল।   তিস্তার ক্ষেত্রেও আমরা আশা করছি ভারত সেই নীতি মেনে চলবে।

বর্তমানে কতটুকু পানি আছে? আদৌ পানি বেড়েছে কি?
আইনুন নিশাত: এই মুহূর্তে আমরা দেখতে পারছি পশ্চিমবঙ্গ তিস্তার পানি ষোল আনাই প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। মাঝে যে অল্প কিছু পানি আমরা দেখলাম এটার সঠিক ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। কারণ আমাদের কাছে উজানের তথ্য-উপাত্ত নেই। তিনটি ব্যাপার হতে পারে। প্রথমত; গজলডোবা ও বাংলাদেশের সীমান্তে ডালিয়া পয়েন্টের মাঝে নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০-৮০ কি. মি। এখানে অনেক ছোট ছোট বেশ কটি নদী আছে। এগুলোর কোনোটির অববাহিকাতে বৃষ্টি হতে পারে। এই তথ্য কেবলমাত্র ভারত সরকারই দিতে পারে। এটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে কয়েক ঘন্টার জন্য পানি বাড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত; তিস্তা একটি ফ্লাশি রিভার— হঠাৎ করেই পানি বাড়ে ,আবার হঠাৎ করেই কমে যায়। এই প্রবণতার সঙ্গে এই যে বেড়ে ৩ হাজার কিউসেক হয়েছিল, সেটা সঙ্গতিপূর্ণ। ৩ হাজার কিউসেক খুব বেশি না। তিস্তাতে বর্ষাকালে ২-৩ লক্ষ কিউসেক পানি থাকে। কাজেই, ৭০০ বা ১৮০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার কিউসেক হয়েছে এটা কোনো বড় বিষয় নয়।
তৃতীয়ত; কিছু আধিকারিক বা কর্মকর্তা বলছেন, মেরামত বা অন্য কোনো কারণে তিস্তা ব্যারাজের গেট খুলতে হয়েছিল। তখন কয়েক ঘন্টা সময়ে কিছু পানি আসতে পারে।
এছাড়া হতে পারে, সে সময় হয়তো কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছু পানি ছেড়েছিল, পরবর্তীতে তা আবার বন্ধ করে দিয়েছে।

তিস্তার পানি ছেড়ে দিলেও কি আমাদের তিস্তা অববাহিকার পানির চাহিদা মিটবে?
আইনুন নিশাত: তিস্তা থেকে পশ্চিম বঙ্গের চাহিদা হচ্ছে ১৬ হাজার কিউবিক ফিট/সেকেন্ড। এই পরিমাণ পানি প্রাকৃতিকভাবে পেতে হলে এপ্রিলের শেষ বা মে-র মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।   আমি মনে করি, এই যে ৭০০-৮০০ কিউসেক আসছে, এটা হচ্ছে গজলডোবা ও ডালিয়ার মধ্যের যতগুলো উপনদী আছে, সেই উপনদীগুলো থেকে একটু একটু পানি এসে এই পরিমাণ পানি হয়েছে। এতে চাহিদা মেটার কোনো কারণ নেই। শুষ্ক মৌসুমে তো নয়ই।
গজলডোবাতে ভারত যে পুরো পানি প্রত্যাহার করছে, এটাকে আমি অনৈতিক মনে করি। নীতিবোধ এক জিনিস আর বেআইনী আরেক জিনিস। উজানের দেশের দায়িত্ব আছে ভাটির দেশকে তার পাওনা অনুযায়ী পানি বুঝিয়ে দেয়ার। এটার জন্য কোনো ফর্মূলা নেই। ফর্মূলাটা হচ্ছে সমঝোতার ভিত্তিতে। উজানের দেশের সুবিধা হচ্ছে যতটুকু পানি প্রত্যাহার করে ততটুকু পানি তার কাজে লাগে। ভাটির দেশের হচ্ছে ভাটিতে প্রকৃতিতেও কিছু পানি প্রয়োজন ও ভাটির দেশের পানি। আমরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি যে, প্রকৃতিকেও কিছু পানি দিতে হবে। নদীকে নদীর জীবন রক্ষার জন্য কিছু পানি দিতে হবে। সেটা ৭০০-৮০০ কিউসেকে কুলায় না, তারচেয়েও বেশি লাগে।
তার ওপর, তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ যদি বজায় থাকে তাহলে শুকলো মৌসুমে এটি ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কিউসেকে চলে আসে যেটা বর্ষাকালে ২ থেকে ৩ বা সাড়ে ৩ লক্ষ কিউসেকে পৌঁছে।

পানি ব্যবস্থাপনা কি সমাধান হতে পারে?
আইনুন নিশাত: অবশ্যই, দুই মৌসুমেই দুই দেশের নদীগুলোতে যে পানি থাকে, তা দিয়ে সারা বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। কিন্তু পানির সে ব্যবস্থাপনা নেই। পানির যৌথ ব্যবস্থাপনা জরুরি।

যৌথ নদী কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই?
আইনুন নিশাত: ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশন ১৯৭৪ থেকেই একরকম নিষ্ক্রিয়। ২০১১ সালের চুক্তিকে কার্যকর করতে হলে নদী কমিশনকেও কার্যকর করতে হবে।

তাহলে শুকনো মৌসুমে সমাধান কী?
আইনুন নিশাত: যেখানে মোট পানি আছে ৫ হাজার কিউসেক সেখানে তিস্তার দুই তীরে ভারতের একার চাহিদাই ২২ হাজার কিউসেক। দুই দেশের চাহিদা হচ্ছে ৩০ হাজার কিউসেকেরও বেশি। তিস্তার পানি না পাওয়ায় এর অববাহিকার প্রায় ৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।   কাজেই শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশের কারোরই চাহিদা পুরোপুরি মিটানো যাবে না। তাই আমাদের উচিৎ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ২০১১ সালের ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির ওপর জোর দেয়া। যেখানে নদী, পরিবেশ ও সেচ রক্ষায় যৌথ উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। তাই সমাধান হচ্ছে, উজানে সিকিমে জলাধার নির্মাণ করে বর্ষার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে  পানি বাড়িয়ে সামঞ্জস্য বজায় রাখা।

কাজেই অববাহিকা ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করা জরুরি। আশা করি, বাংলাদেশ সরকার সে পথেই এগুবে। সরকারগুলো সে পথেই তাদের রাজনৈতিক আলোচনা পরিচালনা করবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।