মানুষকে হরতাল-অবরোধ পালনে বাধ্য করাতে যে সহিংসতা হচ্ছে, তা প্রশ্নাতীতভাবে অন্যায়, অমানবিক। এ নিয়ে কোন বিতর্ক হতে পারে না।
কারা এ-হামলা করছে, তা সুনির্ধারণ খুবই প্রয়োজন। হরতাল-অবরোধ পালনে মানুষকে বাধ্য করতেই এ-হামলা; এ কর্মসূচি আহ্বানকারীরাই আছে হামলার নেপথ্যে। নিরেপেক্ষতার নামে সরকারকে এজন্য দোষারোপের কোনো সুযোগ নেই। কারণ সরকার হরতাল-অবরোধকে কার্যকর হতে দেবে কেন? সবাই আমরা যখন বুঝি সরকারের বিরুদ্ধে এটা এক রাজনৈতিক কর্মসূচি (!)এবং সরকারকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়েই পরিচালিত।
হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীরা মনে করে, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করা গেলে বাংলাদেশে কর্মরত কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপে সরকারকে বিপাকে ফেলা যাবে। কিন্তু সন্ত্রাসের কাছে কোনো দেশের প্রতিনিধি নতি স্বীকার করতে পারে না। কারণ, তাদেরও দেশ, জাতি, সরকার আছে এবং প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। বিদেশিরাও ভিনদেশে নীতিহীন হতে পারে না। অগ্নিগর্ভ পেট্রোল বোমা বা জীবনঘাতী ককটেল হামলায় রাস্তায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে হতাহত করা পাস্তুরিত সন্ত্রাস বৈ আর কিছুই নয়। এ সন্ত্রাসের কাছে নতি স্বীকার করা সন্ত্রাসকে উসকে দেয়ারই নামান্তর। যার প্রভাব সুদূর প্রসারী ও ভয়ঙ্কর। এতে ভবিষ্যতে পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে চলমান ও অপেক্ষমান সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই বার্তাই পেয়ে যাবে যে, সন্ত্রাসের কাছে সার্বভৌম দেশের নির্বাচিত সরকারও বিপর্যস্ত হতে পারে। অতএব অস্থিতিশীলতার মুখে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ সাধারণ মানুষদের প্রতি সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে অর্জিত হবে না। বরং সহিংসতা পরিহার করেই তাদের রাজনৈতিক আচরণ করতে হবে।
আন্দোলন-সংগ্রামে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শীর্ষ নেতৃত্বকে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ১৬ জুলাই ২০০৭ সালে গ্র্রেফতার হওয়ার প্রাক্কালেও জাতির উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখে যান। তাঁর কারান্তরীণ থাকার সময়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে দলের বর্ধিত সভায় সভাপতি শেখ হাসিনার জন্য আসন সংরক্ষিত রেখে পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে কারান্তরীণ থাকা অবস্থায়ও দলীয় প্রধানের সর্বময়তা দলের নেতা-কর্মী এবং তৎকালীন সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এমনি অনেক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এগিয়ে গেছে। সেদিন শেখ হাসিনার পক্ষে জনগণের উদ্দেশে খোলা চিটি লেখা সম্ভব হয়েছিল তার প্রত্যুৎপন্নমতি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনমুখিতার কারণে। রাজনৈতিক আচরণ বা প্রজ্ঞা শিক্ষা করানোর বিষয় তো নয়। রাজনৈতিক জীবন পরিক্রমায় এটি আত্মস্থ করতে হয়। এজন্যই কয়েক দফায় বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগ নীতি নির্ধারণী ও মাঠ পর্যায়ে এমন কিছুই করেনি, যাতে জনমত বিরূপ হয়। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসনের জন্য আকস্মিক অবরোধের কর্মসূচি দিয়ে অনায়াসে তা পালনের পথে না গিয়ে শ্রমসাধ্য চিন্তাশীল বক্তব্য ও কর্মসূচী নেওয়া কী রাজনৈতিক আচরণপ্রসূত কাজ হতো না? প্রধানমন্ত্রীও যেমন জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে (৫ জানুয়ারি) বিএনপিনেত্রীকে দেশের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের উপযোগী কর্মসূচি পেশের কথা বলেছিলেন। যা প্রকৃতপক্ষে জনগণের কাছাকাছি পৌঁছাতে ও সম্পৃক্ত করণে সহায়ক হত। আজকাল মতামত প্রদানের টেলিভিশন প্রোগামগুলোতে প্রায় অধিকাংশই স্বীকার করেন বর্তমান সরকার বিগত ও চলতি মেয়াদে উন্নয়ন মোক্ষমভাবেই করেছে। উন্নয়নের আবহে অভ্যস্ত জনগণ এখন উন্নয়ন নিয়েই গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতিকেই জীবনঘনিষ্ঠ ভাবেন।
সংলাপকে ভাবা হত এই সংকট উত্তরণের উপায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে যখন বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের বন্ধ গেট থেকে ফিরে আসতে হল, এরপর সংলাপ নিয়ে সংশয় দেখা দিল। বিএনপি ‘সংলাপেই সমাধান’-- ভাবলে এমনটা ঘটত না এখন সবাই তা বোঝেন। শোকবই নিয়ে চেয়ারপারসনের একান্ত সচিবের ছুটে আসার বিষয়টিতে চেয়ার-টেবিল ছাড়া বইয়ে স্বাক্ষর অলীক বলে বোঝার বাকি নেই কারও। এজন্যই ঐ রাতেই কয়েকবার চেয়ারপারসেনর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করতে হল। এর মানে তারাও বোঝেন ব্যাপারটি ঠিক হয় নি।
আমরা হরতাল অবরোধ আহবানের বিবৃতিতে খুঁজে পাই, “সরকারের নাশকতা চেষ্টার” কথা। এমন দাবি মানা সত্যিই কঠিন এবং বিবৃতি দান গর্হিত কাজ। কারণ নাশকতা করে সরকার কেন নিজেই নিজেকে সমস্যায় ফেলবে! এহেন লিখিত বিবৃতি—তা-ও আবার দলের কেন্দ্রীয় লেটারহেড সমেত-- জাতির সাথে এক চরম প্রহসন। যা বরদাস্ত করা যায় না কোনোভাবেই।
উপরন্তু, সহিংতার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে বিএনপি ও বিশ দলের নেতারা যতটা সম্ভব এড়িয়ে যান। তার মানে হল তারাও বোঝেন এটা অন্যায়, এটা মানুষের বিপক্ষে যাচ্ছে। প্রকারান্তরে তাদেরও বিরুদ্ধে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। তাই তারা অস্বীকার করেন, তবু হামলা চলছেই। তাদের ভেবে দেখতে হবে, যে-কাজটা তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারছেন না, তবু মানুষ যা বোঝার বুঝছে, তাতে তাদের রাজনৈতিক লাভ হবে কী কোনোভাবে? ব্যক্তিগত জীবনে বিএনপির নেতাকর্মীরাও হরতাল-অবরোধের বিধি-নিষেধ মানেন না। এখানেই আবার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পারঙ্গমতার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৬ সালে আহুত অবরোধে রিকশায় চড়ে শেখ হাসিনার দলীয় কার্যালয় অভিমুখে যাত্রাকালে ধারণ করা ছবিটি যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
আসন্ন এস এস সি পরীক্ষাকালীন অবরোধ প্রত্যাহারে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী আহ্বান করেছিলেন। তাতে পরীক্ষা শুরুর তারিখে অবরোধের মধ্যে এল হরতাল । সবচে’ বেশি মনোযোগ কাড়ে যে পাবলিক পরীক্ষা সে-সময়েই বিএনপি ও নেতৃত্বাধীন জোটের এহেন আচরণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত সকলকে আরও বিচলিত করল। আবার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষার্থীদের অবরোধের আওতার বাইরে রাখার ইতোপূর্বের ঘোষণা দুর্ভাবনার সাথে এক্ষণে বৈষম্যের ভাবনাও মনে আনল। হরতাল পরীক্ষার মুখেই আরোপ করার কারণ কী? অবরোধেই তো যথেষ্ট অস্বস্তি ছিল। তবে কেন আরও প্রতিবন্ধকতা আরোপ? এর আগেও পাবলিক পরীক্ষার তারিখ পেছানোর দৃষ্টান্ত আছে।
নিয়মিত-নির্বাচিত সরকারকে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ছাড়া ক্ষমতাচ্যুত করার কোনো নজির এদেশে নেই। গণতন্ত্রবর্হিভূত শক্তি ক্ষমতাসীন হয়েছে বরাবরই টালমাটাল অস্থায়ী সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে। আর রাজনীতিতে ঐতিহ্যবান ও বারংবার গণ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে বাংলায় আসন্ন এক বসন্তে (ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে) ব্যর্থ প্রমাণের সম্ভাবনা অবস্থাদৃষ্টে বড় ক্ষীণ মনে হয়। তাহলে সে আশায় মাধ্যমিক পরীক্ষায় আরও বেশি বাধা দানের লাভ হবে কী এবং কার? অনন্তকালের এ অবরোধ সংগ্রাম (!) বাস্তবতার নিরিখেই থামাতে হবে। কিন্তু শিক্ষাজীবনসহ জান-মালের যে অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গেল, তার পূরণের কী হবে?
তাহলে দ্রুততমভাবে দমন করতে হবে এ-সহিংসতা। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, গণতান্ত্রিক সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও দণ্ডহস্ত হওয়ায় কিছুটা নমনীয়তা এবং সময় সাপেক্ষতার ফের থাকে। আমরা যেকোনো বিশেষ অভিযান ও অবস্থাকালে অতীতে দেখেছি সন্ত্রাস রাতারাতি নির্মূল অসম্ভব নয়। কিন্তু সেই অপ্রিয় কাজগুলো আওয়ামী লীগ সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন না করায় টেকসই কোন প্রতিকার খোঁজাই তাদের কর্তব্য হবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা বা মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার এত কথার মাঝেও যেটা আলোচিত নয় তা হল নির্বাচনী সহিংসতা। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট জয়লাভে ব্যাপক নির্বাচনোত্তর সহিংসতা হয়। পক্ষান্তরে ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট আরও বিশালাকারে জয়ী হলেও নির্বাচনী সহিংসতা তো নয়ই, কোন বিজয় মিছিলও হয় নি। তদানীন্তন অপেক্ষমাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বিজয় মিছিল করাও বারণ করে দেন। দুঃখজনক হল নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধে আমাদের খুব একটা কথা বলতে শোনা যায় না। আরও দুঃখের বিষয় হল, তখনও বলা হত আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত অঞ্চলে ভোটে হেরে আওয়ামী লীগের হাতেই এসব সহিংসতা চলছে। সমাধান খুঁজতে হলে প্রথমে দায়ী কারা তা নির্ধারণ করতে হবে। নির্বাচন মানেই সহিংসতা না, ভিটেছাড়া হওয়া না—এই ধারণাকে সর্বব্যাপীকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সুসংসহত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেসসচিব
asifkabir62@yahoo.com