ঘটনা-১
আমার এক সিনিয়র বন্ধু দেশের উদীয়মান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। বছর সাতেক আগে ইউরোপ থেকে ‘কম্পিউটার সিস্টেম ও নেটওয়ার্কস’ এর ওপর উচ্চশিক্ষা শেষ দেশে ফিরেছেন।
দেশে ফিরে প্রথম দিকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেও কয়েক বছরের মাথায়ই নিজে ব্যবসা শুরু করেন। স্বাধীনভাবে কিছু করার প্রত্যয় থেকেই শিক্ষকতা বাদ দিয়ে ব্যবসা শুরু করা। কঠোর পরিশ্রমে মাত্র চার/পাঁচ বছরের মাথায় সে নিজেকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন।
সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত টেন্ডার পান তিনি। একই সাথে এ অল্প সময়ে একটি প্রডাক্টশন হাউজও খুলেছেন। যেখান থেকে বেশ কয়েকটি নাটক নির্মিত হয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিতও হয়েছে।
কিছুদিন আগে জানালেন, বছরখানেক আগে কয়েকজন বন্ধু মিলে রাজধানীতে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার দেখা দেশের তরুণ-উদীয়মান সফল ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার মধ্যে তিনি একজন। সুযোগ পেলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্কাইপিতে তার সাথে কথা হয়।
কিন্তু বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অস্থিরতার কারণে তার সকল প্রজেক্টের কাজ স্থবির হয়ে আছে। নিজের ওপর ও দেশের ওপর অনেক বিতশ্রদ্ধ তিনি। কিছুদিন আগে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, “এভাবে একটা দেশে বসবাস করা যায় না। আমাদের মত সাধারণ মানুষের এই দেশ না। ”
ঘটনা-২
এই লেখা শুরু করার আগে কথা হচ্ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতার সাথে। দেশে থাকতে যখন হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) ছিলাম সে প্রায়ই আমার রুমে আসতো সাংবাদিক হওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে।
যাই হোক, ২০১৩ এর প্রথম দিকে হল ছাড়লে কিছুদিন পরে শুনি সে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। মিছিলের কোন ছবি দেখলেই তাকে দেখি সবার আগে। আমি বিদেশে পড়তে আসার পর থেকে প্রায়ই সে যোগাযোগ করতো।
সে জানালো, ‘ভাই দেশের অবস্থা ভাল না। এই দেশে আর থাকবো না’। আমি বললাম, ‘কেন, পড়ালেখা শেষ করলেই তো ভাল চাকরি পাবি। যে দল করস, চাকরি পাওয়ার জন্য তো এর চেয়ে বেশি কিছু লাগবে না’।
উত্তরে সে বললো, ‘ভাই, তোষামোদী ছাড়া এখানে টিকে থাকা যাবে না। চাইলেও ভালো থাকতে পারবো না’।
এরপর আমি বললাম, ভেবে দেখ কী করবি।
ঘটনা-৩
কয়েকদিন আগে গবেষণার কাজে কিছু পরিসংখ্যানের জন্য ক্যাম্পাসের এক জুনিয়রকে নক করলাম। বর্তমানে সে একটা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার। কথোপকথনের এক পযার্যে সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই পড়াশোনা শেষ করে কী করবেন? আমি বললাম, দেশে এসে মাস্টারি করবো। এ কথা শুনে সে আমাকে বললো, যেন দেশে না ফিরি, আধ ঘণ্টা বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো।
আমি বললাম, ঠিক আছে দেখি। তার কথার টোন শুনে যা বুঝলাম দেশের প্রতি চরম মাত্রায় বিতশ্রদ্ধ সে। বললো, ‘কোন রকম সুযোগ পেলেই এ দেশকে গুডবাই জানাবো’। আমি বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে দেইখো। সে বললো, না ভাই কোনদিনই এ দেশ ঠিক হবে না। আমি আর কথা বাড়াইনি।
এরপর সে যা বললো তার সারমর্ম হলো, এদেশে ভাল মানুষ হয়ে থাকা যাবে না। ভাল মানুষ হয়ে থাকতে চাইলে না খেয়ে মরতে হবে। আরো অনেক কিছু।
উপরের তিনটি ঘটনা বলে দেয় দেশের শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের মনে অবস্থা। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এরকম অসংখ্য তরুণ-উদীয়মান উদ্যোক্তা, রাজনীতিক, সাংবাদিক, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত যুবক, সদ্য উচ্চ শিক্ষা শেষ করাসহ সমগ্র তরুণ-যুব সমাজ আজ চরমভাবে হতাশাগ্রস্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণ, একই সাথে চার বছর ক্যাম্পাস রিপোর্টিং ও পরে একটি ইরেজি দৈনিকে দু’বছর কাজ করার ফলে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিশেষ করে তরুণ-যুবক এবং বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছিলো। অনেকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কও গড়ে ওঠে। সে সুবাদে প্রবাসে থাকলেও এখনো অনেকের সাথেই অনলাইনে যোগাযোগ হয়। ফোনেও কথা হয় অনেকের সাথে। গত কয়েক মাসে যতজনের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, প্রত্যেকের মুখেই একটা কথা, “ভাই এদেশে আর থাকবো না, বিদেশ চলে যাবো। আমাকে আমেরিকা নেয়ার ব্যবস্থা করেন, ইত্যাদি”।
যাই হোক, শুরুতেই আমি যে তরুণ উদ্যোক্তা বন্ধুর কথা বলেছি সে ইচ্ছে করলেই বিদেশে থেকে যেতে পারতো। ইউরোপের বিলাসী জীবনকে উপক্ষো করে মা-মাটির টানে উচ্চ শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসেছে। একই সাথে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তাদের ছোট ছোট উদ্যোগে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচলে সে ভূমিকা রেখে চলছে। স্বনির্ভর এ যুবকদের দেশ থেকে কোন কিছু প্রত্যাশা নেই ব্যবসা ও বাস করার একটি সুন্দর পরিবেশ ছাড়া।
অপরদিকে উপরে যে তরুণ, যে ছাত্ররাজনীতিকের কথা বলেছি, দেশকে ভালোবেসেই তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। অনিশ্চয়তায় তিনি দিন কাটাচ্ছেন। যখন তখন সেখানে সেখানে পেট্রোল-বোমা হামলার শিকার হওয়ার ভয় তাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই অনুমেয় যে, আমাদের রাজনীতিকদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে কোন ভাবনা নেই। সরকারি ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যেমন তরুণদের ব্যবহার করছে ঠিক তেমনি বিরোধীদলও ক্ষমতা অর্জনে তরুণদের ব্যবহার করছে। বিরোধীদলের আন্দোলনে তরুণদেরই রাস্তায় দেখা যায়। মরেও তরুণরাই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৩) তথ্য মতে, দেশে বর্তমান মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশের বয়স ২০ থেক ৩৫ বছর। সে হিসেবে বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি নাগরিক তরুণ-যুবক। আর জনসংখ্যার এ অংশটাই দেশের মূল চালিকা শক্তি। সামনে তারাই দেশেকে নেতৃত্ব দেবে। অথচ তাদের মধ্যে যদি দেশের প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হয়, দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা হয় তাহলে ভবিষ্যতে এ দেশের নেতৃত্ব দেবে কে?
গণতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দলের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া এবং দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্রবিরোধী কোন সিদ্ধান্ত নিলে বিরোধীদল সরকারের সমালোচনা করবে, আন্দোলন করবে, জনমত গঠন করবে, এটাই স্বাভাবিক। গণতন্ত্রের সংজ্ঞানুযায়ী, বিরোধীদলের দায়িত্ব এটিই। কিন্তু সরকার বিরোধীদের মোকাবেলার নামে পাড়ায় পাড়ায় যে প্রতিরোধ কমিটি এবং বংশ নির্মূলের যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে করে দেশে কখনো শান্তি ফিরে আসবে না।
আমাদের সমাজে অনেক পরিবার আছে যেখানে বাবা বিএনপির রাজনীতি করলেও ছেলে আওয়ামী লীগ অথবা ছাত্রলীগ করে অথবা দুই ভাই দুই ধারার রাজনীতি করে। সরকারের এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য আমাদের চিরাচরিত যে সামাজিক বন্ধন আছে সেটাকে শুধু স্থায়ীভাবে ফাটলই ধরাবে না বরং ভাতৃঘাতী সংম্পর্ক তৈরি করবে। যা কোনভাবেই আমাদের জন্য সুখকর হবে না।
আমাদের ভবিষ্যত এবং নবীন প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা সমাজ গড়ে দেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। সেটা না করে স্বপ্নচারী তরুণ-যুবকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেকে দিয়ে তাদের জীবন বিপন্ন করার অধিকার আমরা রাখি না। দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন শিক্ষিত যুবকরা নিজে নিজে কিছু করার প্রয়াস পায়। একই সাথে যারা বিদেশে চাকরি অথবা পড়াশোনা করছে তারাও যেন দেশে এলে স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পায় সে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, এ দেশটা আপনার আমার, আমাদের সবার। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু সেটা আমাদের মাঝে যেন বিভাজন ও সংঘাতকে উসকে না দেয়।
সব রাজনৈতিক দলকে আগে দেশের কথা ভাবতে হবে। দেশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। তরুণদের কথা ভাবতে হবে। তাদের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বপন করতে হবে। তাদেরকে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, যেদিন বাংলাদেশের তরুণ-যুবক সব ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে সেদিনই বাংলাদেশ তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছুতে পারবে।
দিদারুল ইসলাম মানিক: গ্রাজুয়েট রিসার্স অ্যাসিসট্যান্ট, ইউনির্ভাসি অব সাউথ ড্যাকোটা, যুক্তরাষ্ট্র, didar.manik@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫