আমরা যারা প্রবাসে থাকি তাদের পথ বেশ পিচ্ছিল। অনেক প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।
আদিনিবাস বাংলাদেশের কথা বললে এমনও অনেকে আছেন, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকবেন। যেন বাংলাদেশ নামক দেশটির উপস্থিতি এ গ্রহে নয়। এ জীবনে এর আগে কখনো দেশটির নাম তিনি শোনেননি। ভৌগলিক অবস্থান তুলে ধরে অনেক কষ্ট করে বুঝাতে পারলেও কেউ কেউ বলে উঠবেন, ও! ওই বাংলাদেশ যেখানে- নিত্য সুনামি হয়, বন্যা-সাইক্লোন লেগে থাকে, রানাপ্লাজা ট্র্যাজেডি ঘটে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সর্বপরি নেতাদের মাঝে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কামড়াকামড়ি চলে, সেই বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ যে ক্রিকেটের দেশ বা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের দেশ সেটা তাদের কথায় ফুটে ওঠে না। উপরন্তু তাদের এগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিলে অনেকটা অবাক হয়ে বলবে “ও রিয়েলি!” এই হল আমাদের দেশ সম্পর্কে অধিকাংশ বিদেশির ধারণা।
এ ছাড়াও প্রবাসে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন রকমের বদনাম তো রয়েছেই। চুরি-চামারি, নারী কেলেঙ্কারি, এমনকি জঙ্গি কার্যক্রমের মতো বিভিন্ন কুকর্মে লিপ্ত হতে দেখা যায় কোন কোন বাংলাদেশিকে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার যে কয়টি দেশে বাংলাদেশিদের বসবাস রয়েছে তার সব কটিতেই এ ধরনের সমস্যা প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এমনকি শান্তিপ্রিয় দেশের তালিকায় যেসব দেশের নাম রয়েছে সেগুলোও এর রাহুমুক্ত নয়।
পক্ষান্তরে এসবের পরেও বিদেশে বাংলাদেশিদের যে কোন সুনাম নেই তা নয়। কর্মক্ষমতা, নৈপুণ্য, কাজেকর্মে কৌশলী মনোভাব ও আলস্যহীনতা, কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও দক্ষতা, চৌকস ও প্রত্যুৎপন্নতার বহিঃপ্রকাশ, বন্ধুভাবাপন্ন অতিথিপরায়ণতা, সর্বপরি যে কোন বিষয়ে সম্মিলিত সহযোগী প্রচেষ্টার পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি ইতিবাচক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের একটি গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তিই ফুটে উঠেছে।
আমার এখনো মনে পড়ে, আজ থেকে প্রায় বার-তেরো বছর আগে সিঙ্গাপুরে থাকাকালে আমার সেখানকার বস কোন এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে বলেছিলেন, ‘তোমরা বাঙালিরা যেমন কর্মঠ তেমনি অন্য দশটা জাতির তুলনায় বেশ ভালো ও স্মার্ট। ’
কিন্তু এ ইমেজ ও সুনাম আমরা সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারছি না। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশি রয়েছে। গর্বের সাথে কাজকর্ম করছে। কিন্তু হাতে গোনা দু’একজনের কুকর্মের কারণে পুরো জাতির সুনাম দু:খজনকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। এদের সাথে এবার নতুন করে কলঙ্কের খাতায় নাম লিখিয়েছেন দেশের প্রথম শ্রেণীর একজন নাগরিক। জাতিকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর মতো লজ্জাজনক এ ঘটনাটি যিনি ঘটিয়েছেন তিনি বেসরকারি এক স্যাটেলাইট টিভি চ্যনেলের সাংবাদিক।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খবর পরিবেশনের জন্য তিনি অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছিলেন। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বসে ষোল বছরের অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক ঘুমন্ত কোরিয়ান মেয়ের শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি। এর জের হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান পুলিশ বিমানবন্দর থেকেই তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং জেল হাজতে পাঠায়।
স্থানীয় কোন আইনজীবীর শরন্নাপন্ন হয়ে জোর প্রচেষ্টা চালালে তার জামিনের ব্যবস্থা হলেও হতে পারে। জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি আবারো সংবাদ পাঠানোর কাজেও নিয়োজিত হতে পারবেন। কিন্তু মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে অস্ট্রেলিয়াতেই থাকতে হবে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সাক্ষীর মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে তাকে অন্তত ৬ মাস থেকে ১ বছরের জেল খাটতে হবে- এতে কোন সন্দেহ নেই।
সাংবাদিকতা প্রথম শ্রেণীর একটি পেশা। জাতির বিবেক হিসেবেও ধরা হয় সাংবাদিকদের। ব্যক্তি, সমাজ তথা দেশ ও জাতির দিকনির্দেশক হিসেবেও কাজ করেন তারা। অস্বচ্ছ ও ঘুনে ধরা সমাজকে সত্য সুন্দর পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করেন। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে কেবল সত্য উন্মোচন করেই ক্ষান্ত থাকেননা তারা, সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করে সমস্যা সমাধানের পথও বাতলে দেন। দেশ পরিচালনার জন্য যে কয়টি স্তম্ভ রয়েছে তন্মধ্যে সংবাদপত্র একটি। এ সংবাদপত্র যারা পরিচালনা করেন তারাই হলেন সাংবাদিক।
এমন একটি মহৎ ও গুণি পেশার অধিকারী হয়েও একজন যদি এ ধরনের ঘৃণিত কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন তাহলে ওই দেশটির সাধারণ মানুষ সম্পর্কে বিদেশিদের কি ধারণা জন্মাবে? বিশ্ববাজারে এর কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না? তার এই অপকর্ম কি কেবল তাকেই ছোট করেছে? পুরো সাংবাদিক জাতসহ দেশ ও জাতির ভাবমূর্তিও নষ্ট করেছে।
দেশে হরতাল অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতার ফলে অর্থনীতিতে যে লালবাতি জ্বলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তার এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতটিও যে কোন না কোনভাবে রাহুগ্রস্ত হবে না সে কথা হলফ করে বলা যায় না।
অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে নিজেদের অসুর প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মনুষ্যত্ববোধ। এ মনুষ্যত্ববোধের বাইরে গিয়ে সুখ ধরতে চাইলে তা প্রকৃত সুখ হয়ে ধরা দেয়না বরং তা অবাঞ্ছিত দুঃখে রুপ নিয়ে হৃদয়ে জ্বালাময়ী আঘাত হানে।
যিনি সংবাদ কাভারের প্রয়াসে দেশ ত্যাগ করে গেলেও স্বীয় কৃত কর্মের ফলে অস্ট্রেলিয়ার জেলে রাত কাটাচ্ছেন তিনি অনুতাপের আগুনে পুড়ে পুড়ে এ সত্যটি অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করছেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের সবারই নিজ নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যাবশ্যক। কোন কিছু করার আগে পেশাগত মর্যাদার কথাটা মাথায় রাখা উচিত। এমন কোন কর্ম করা ঠিক নয়, যা কেবল নিজ বোধ-ভবিষ্যৎ, পেশা বা জীবনের জন্যই বৈরি হয়ে ওঠে না, বরং দেশ ও জাতির মুখেও চুনকালি লাগিয়ে দেয়।
সাজেদুল চৌধুরী রুবেল: আয়ারল্যান্ড প্রবাসী লেখক, Shajed70@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫