কৃষক বাঁচান, মানুষ বাঁচান- এ শিরোনামে কিছু লিখতে হবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি। কারণ বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর একটি দেশ।
বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা হরতাল অবরোধে কৃষকদের স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নাশকতার আশঙ্কায় পরিবহন সংকটে কৃষক তার পণ্য গ্রাম থেকে রাজধানী বা জেলা শহরে পাঠাতে পারছে না। ফলে কৃষকরা আজ পথে বসেছে। অনেকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। সরবরাহ সমস্যায় অনেক চালকল বন্ধ হওয়ায় কমে গেছে ধানের দামও। শীত মৌসুমকে সামনে রেখে যে স্বপ্ন তারা বুনেছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়ার পর সবজিবাহী ট্রাক চলাচল বাড়লেও ব্যবসায়ীরা কম দামে সবজি কিনলেও ট্রাক ভাড়া অনেক বেশি। তাই তাদেরও খুব লাভ থাকছে না, সঙ্গে থাকছে জীবনের ঝুঁকি।
বর্তমানে রাজনৈতিক এই অস্থিরতায়, পরিবহন সংকটের কারণে দেশের বিভিন্ন মোকামে ও হাট-বাজারে প্রতি কেজি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে এক টাকায়। অথচ কৃষি বিভাগের হিসাবে প্রতি কেজি ফুলকপি উৎপাদনে কৃষকের নিট খরচ হয় চার টাকা। অবরোধের আগে আলুর মণ ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে আড়াইশ’ থেকে ২৮০ টাকা মণ। একই চিত্র অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রেও। এভাবে যদি চলে তাহলে কৃষক ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে। শুধু কৃষক মরবে না, আমাদেরও মরতে হবে।
আর দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এককথার, কৃষিপণ্যের অগণিত উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই এখন চরম দুর্ভোগের শিকার। এক দলের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত পণ্য পঁচে যাচ্ছে এবং এভাবে তারা লোকসান দিচ্ছে। আরেক পক্ষ অর্থাৎ শহর এলাকার ক্রেতারা বাজারে সরবরাহ কম থাকায় বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এটাও জানা কথা যে, হরতাল-অবরোধে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বঞ্চিত হয় বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য আয়-উপার্জন থেকে। আমার প্রশ্ন হলো- এ ধরনের কর্মসূচি থেকে কৃষিপণ্যকে ছাড় প্রদান করা যায় না? এমনটি ঘটলে কৃষক বাঁচে, ভোক্তাদেরও খানিকটা স্বস্তি মেলে। ২০১৩ সালে হরতালে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই আবারো আঘাত এল। এ অবস্থায় কৃষক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি ?
চাষিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজি, ফুল আর ফল চাষ করে। এখন সবজির ভরা মৌসুম। অথচ এই ভরা মৌসুমেই কৃষককে লোকসানের বড় অঙ্ক গুনতে হচ্ছে। বড় ধরনের লোকসানের বোঝা চাপবে অনেকের কাঁধে। এই ক্ষতি পূরণ না হলে তারপক্ষে আগামী মৌসুমে সবজির উৎপাদন কষ্টকর হয়ে পড়বে। ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে কৃষককে অসহায় হয়ে পড়তে হবে। দৈনিক পত্রিকার সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, প্রতি বছর শীত মৌসুমে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষিরা উৎসবে মেতে থাকতেন এ সময়। আর এখন সেখানে বিরাজ করছে চরম হতাশা। শুধু রাজশাহীর টমেটো চাষিরা কেন, বগুড়ার আলু চাষি, ঝিনাইদহের ফুল চাষি-তাদেরও একই অবস্থা। সরবরাহ সমস্যায় অনেক চালকল বন্ধ হওয়ায় কমে গেছে ধানের দামও। বেকার হয়ে গেছেন অনেক শ্রমিক। এই যে, পহেলা ফাল্গুন এর বিশ্ব ভালবাসার দিবস চলে গেল। যশোরের ফুল চাষীরা তারা তাদের ফুলের কাঙ্খিত দাম পেলেন না।
বিএনপি-জামায়াত জোটের চলমান সহিংসতা শুরুর আগেই আমন ধান ঘরে তুলতে পেরেছিল কৃষক। আর বোরো ধানের চাষও শুরু হয়েছে। বোরো ধানের চাষের সময়ে যদি কৃষক উৎপাদনে বাধা পায়, তাহলে তার নেতিবাচক ফল সারা বছর ভোগ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে পড়বে। দেশে চালের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো থেকে। তাই এ সময়ে বোরো উৎপাদনে প্রয়োজন মতো সার ও সেচের জ্বালানি না পাওয়া গেলে মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। আমন ধান চাষীরা ধান ঘরে তুলতে পারলেও পরিবহন সংকটের কারণে বাজারে ধান বিক্রিও প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
দেশের চালকলগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো-হাসকিং-মেজর মিল মালিক সমিতি সংগঠনটির হিসাবে দেশে প্রায় ১৭ হাজার চালকল রয়েছে। অবরোধের কারণে ৭০ শতাংশ চালকল বন্ধ রাখা হয়েছে। আর দেশের বিভিন্ন বাজারে চালকলগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন চাল সরবরাহ হতো। কিন্তু এখন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার টন চালও সরবরাহ হচ্ছে না। ঢাকা চেম্বারর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তথ্য অনুযায়ী চলমান হরতাল, অবরোধে কৃষি খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ২৮৮ কোটি টাকা।
যে কোনো মূল্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারলে ক্রমাগতভাবে কৃষিখাতে যে ধস নেমে আসবে যা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তা বাস্তবায়ন করতে গেলে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকের উন্নতি করতে হবে। কৃষিখাতকে বাদ দিয়ে বা কৃষকের স্বার্থকে উপেক্ষিত করে তা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। শুধু কৃষি ভর্তুকি, সার, বীজ সরবরাহ করলেই হবেনা একই সঙ্গে কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধান চালের উপযুক্ত মূল্য যেন কৃষক পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় কোনো কার্যকর সংগঠন নেই। যদিও মূল রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর যেমন কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক দল, শ্রমিক দল সহ কিছু অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন রয়েছে। কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের নামে এসমস্ত সংগঠন কৃষকের স্বার্থে কতটা অবদান রাখছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
কৃষিনির্ভর আমাদের অর্থনীতির প্রাণ দেশের কৃষক। আমাদের রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে তাদের বাঁচানোর উদ্যোগ রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। এমতাবস্থায়, বিএনপি ও তাদের সহযোগীদের দেশের স্বার্থে তথা কৃষক সমাজকে বাঁচানোর জন্য এসব ধ্বংসাত্মক অরাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। সংকট, সমস্যা থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে হবে। দেশের এই চলমান সংকট আরও কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, কৃষকের কথা বিবেচনা করে শিগগিরই আইনের মাধ্যমে কৃষি পণ্যকে হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হোক।
বর্তমানে কৃষকের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে আর যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে সবাইকে সমান দৃষ্টি দিতে হবে। বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরকার কৃষকদের পুনর্বাসন কর্মসূচিসহ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়; এক্ষেত্রেও তেমন করতে হবে। তাহলে কৃষক বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
লেখক: প্রফেসর মো. শাদাত উল্লা, উপাচার্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ০৮০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫