যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে নানাকথা শোনা যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে পৃথিবীর ভয়াবহতম মানবাধিকার লংঘনের ইতিহাস কে না জানে? সেই সব রোমহর্ষক ঘটনায় নির্যাতিত মানুষ, কিংবা জান-মাল হারানো মানুষের স্বজনরা এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন।
মুক্তিযুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আল বদর-আল-শামসের লোকেরা কতখানি ভয়ংকর এবং কতভাবে মানবাধিকার লংঘন করেছে, তা সবাই জানে। নতুন করে বলার কী আছে? তারপরেও নতুন করে বারবার বলতে হচ্ছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবাই জানে, কিন্তু সবাই মানে না। সে কারণেই জামায়াত-শিবির এবং তাদের সহযোগীরা সরাসরি মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তারা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকে। এক শ্রেণীর কুশীল ‘কিন্তু’ ‘তবে’ ‘যদি’ এই তিন শব্দের নজিরবিহীন অপব্যবহার করে বলেন- ‘বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্মত’।
বাংলাদেশে সংঘটিত সকল অপরাধের বিচার যদি বাংলাদেশের আইনের অধীনেই হতে পারে, তাহলে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বেলায় আন্তর্জাতিক মান দরকার হবে কেন? ইসলামের নাম ব্যবহার করে নানা রকম নামধারী রাজনৈতিক দল, জঙ্গি সংগঠনের লোকেরা বিচারকার্য ব্যহত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। এরাই এখন বাংলাদেশে বসে যা কিছু করা যায়, তার সব কিছুই করে যখন পুরোপুরি ব্যর্থ, তখন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ব্যক্তিদের হাতে-পায়ে ধরা শুরু করেছে। তারই প্রেক্ষিতে একটি আন্তর্জাতিক কৌতুকও মঞ্চস্থ হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, কামারুজ্জামান নামক এক মানবতাবিরোধী অপরাধীর তথা মানবাধিকার লংঘনকারীর জন্য মানবাধিকার চাচ্ছে। আমাদের কথা হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘের এই সংস্থাটি ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তানকে কিংবা তাদের দোসর জামায়াত-শিবির রাজাকারদের কি একবারের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছে? কিংবা কোনো চিঠি? না, দেয় নি। তাহলে কোন অধিকারে তারা এখন একজন প্রমাণিত এবং দণ্ডিত অপরাধীর ব্যাপারে মানবাধিকার ফলাতে আসে? বাংলাদেশের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি এখনো বহাল আছে। এটা সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
এরশাদ শিকদার নামক ভয়ংকর খুনির ফাঁসি হয়েছিল। তখন কি কেউ তার মানবাধিকারের কথা বলেছিল? কিংবা রিমা হত্যাকারী সেই মুনিরের ফাঁসির আদেশ কার্যকরের সময়? কেউ বলেনি। তাহলে এখন কেন এতো হা-হুতাশ, কেন এতো মানবাধিকারের প্রশ্ন?
কোনো দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার আওতায় যখন কোনো বিচারকার্য চলে, তার প্রেক্ষিতে মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলা যায় কি না?
ফ্রান্স পৃথিবীর অন্যতম একটি সভ্য দেশ। সেখানে কিছুদিন আগে একটি কার্টুন পত্রিকার অফিসে বোমা হামলা করে প্রাণহানি ঘটানো হয়। ফ্রান্সের পুলিশ প্রশাসন ত্বড়িত ব্যবস্থা নিয়ে হামলাকারীদেরকে পাগলা কুকুরের মতো গুলি করে হত্যা করেছে। তাদের হত্যার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা কোথায় ছিল? কই কোনো বিবৃতি তো দেখিনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দুষ্টের দমন এবং শিষ্ঠের পালন করা।
শিষ্ঠের পালন করতে রাষ্ট্রকে যত রকমভাবে কঠিন হওয়া দরকার, হতে হবে। এ ব্যাপারে ছাড় দিলে রাষ্ট্র দুষ্টের প্রতিপালক হয়ে যাবে। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পরাশক্তিধর দেশ এবং সংস্থাসমূহ সবসময়ই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গোল বাঁধাবার চেষ্টা করে।
কথিত আছে, কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর না করতে আমেরিকার এক মন্ত্রী চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। গুয়ান্তানামোবেতে মুসলমানদের সাথে আমেরিকা কোন্ ধরনের মানবাধিকার প্রদর্শন করেছে? যুক্তরাষ্ট্রের আইনে মৃত্যুদণ্ড এখনো বহাল আছে এবং তারা তা প্রয়োগ করছে। তাহলে কোন মুখে তারা বাংলাদেশে নাক গলায়? জাতিসংঘের নামই United nations Organization (UnO) তো ঠিক নেই। জাতিসংঘ কি পৃথিবীর সব জাতির প্রতিনিধিত্ব করে? পৃথিবীতে হাজার হাজার জাতি আছে। এই সংগঠন তাদের সকলের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা শুধু অধিকাংশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই তাদের নাম হওয়া উচিত, United States Organization (USO)। এই সংগঠনের মহাসচিবের কিংবা সহযোগী সংগঠনের কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে যারা বিভক্ত মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন, তারা একজন ভয়ংকর মানবতাবিরোধী অপরাধীর মানবাধিকারের কথা বলছেন। তারাই কিন্তু বাস-ট্রাকে পেট্রোল বোমা হামলায় ১৯৩ জন সাধারণ মানুষ হত্যার পক্ষে, কবি-লেখকদেরকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করার পক্ষে নানা রকম কুযুক্তি দিয়েছেন।
মানবাধিকার কি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য? ১৯৩ জন সাধারণ মানুষ কিংবা ৮ জন মুক্তমনা কবি-লেখকদের মানবাধিকার নেই? তখন তারা একটি কথাও বলেন নাই। কিন্তু তারা ক্রসফায়ার এবং গুমের প্রতিবাদে আবার সোচ্চার। মানবতা, মানবাধিকার প্রশ্নে তারা একবার নীরব থাকেন, আরেকবার সরব হয়ে উঠেন।
কেন এই ডাবল স্টান্ডার্ড? মানবাধিকার প্রশ্নে ডাবল স্টান্ডার্ড এর কোনো সুযোগ নেই। কেউ অপরাধী হলে তার বিচার হতে হবে আইনের আওতায়, গুলির আওতায় নয়। কাউকে গুম করা যাবে না। কাউকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা যাবে না। কোনোভাবেই তা সমর্থনযোগ্য নয়। এসব নৈরাজ্যতা, অরাজকতা সৃষ্টি করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। পৃথিবীর কোথাও হয়নি।
সাম্প্রতিক কালের বহুল উচ্চারিত সন্দেহ, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবার কৌশল খুঁজছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কি কামারুজ্জামানের অপরাধীকে ক্ষমা করে দেবেন? সে কারণেই কি নানা অযুহাতে এই কালক্ষেপন? পর্দার অন্তরালে কি সেরকম কোনো নীল-নকশা বাস্তবায়ন হচ্ছে? নানা রকম কথা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ বলছেন, ক্ষমা মহৎ গুণ। দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষা চাইলে, প্রাণ ভিক্ষা দেয়াই যেতে পারে। তাতে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও আসবে। আসলেই কি তা হবে? বঙ্গবন্ধু যাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আওয়ামী লীগকে আজও ক্ষমা করেনি। সেই সব ক্ষমাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরাই এখন জামায়াত ইসলামের বিভিন্ন জেলা শাখার আমীর, মজলিশে সূরার সদস্য। তারা এখনো দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সুতরাং ক্ষমা সকলের প্রাপ্য নয়। এটা প্রমাণিত সত্য। আমরা নাকের বদলে নরুন চাই না, কামারুজ্জামানের ফাঁসি চাই। কেউ কেউ বলছেন, সরকারের উপর নানামুখী চাপ আছে যাতে কামারুজ্জামানকে ফাঁসি দেয়া না হয়। বাউন্স বল করলে হুক শট খেলা ছাড়া উপায় কি?
টানেকিশেমজা খ্যাত (টাংগাইল, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং জামালপুর) এক বিরাট অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষকে শায়েস্তা করার এক কুদায়িত্বে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত ছিল এই কামারুজ্জামান। প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি কামারুজ্জামানকে ‘আপনি’ সম্বোধন করছি না। যদিও বিভিন্ন মিডিয়া তার প্রতি সম্মান দেখাতে যারপরনাই সচেতন ভুমিকা পালন করছে। সম্মানপূর্বক ‘আপনি’ সম্বোধনে তার খবর প্রচার এবং প্রকাশ করছে। সম্মান তো ইতিবাচক বিষয় কিংবা ব্যক্তির সাথে যায়। ভয়ংকর অপরাধীকে যদি সম্মান দেখানো হয়, তাহলে নিরাপরাধ কিংবা সম্মানী মানুষের ক্ষেত্রে কি ট্রিটমেন্ট দেয়া হবে? এক্ষেত্রে আমি সচেতনভাবেই কোনো ধরনের সম্মান প্রর্দশনের পক্ষে নই। ‘তার’ লিখতে চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করার পক্ষেও নই। যদিও রাষ্ট্রীয় রসিকতার অনেক নজির আছে।
একটা উদাহরন দেয়া যাক, কাউকে ফাঁসি দেবার আগে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এটা অনেকটা সেই কৌতুকের মতো, একজন লোক হেরিকেন জ্বালিয়ে রাতের বেলা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো-
‘কই যাও?’
‘আত্মহত্যা করতে। ’
‘হেরিকেন জ্বালিয়ে কেন?’
‘সাপ-খোপের ভয় আছে না?’
গত কয়েকদিন ধরে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে সারা পৃথিবীর বাংলাদেশিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশে যারা আছে, তাদের অপেক্ষার সময় এক রকম। আর প্রবাসীদের সময় আরেক রকম। কারো জন্য গভীর রাত, কারো জন্য কাক-ডাকা ভোর। কাজ-কর্ম, অফিস, ব্যবসা-বানিজ্য তো আছেই। তারপরও অপেক্ষায় আছেন। অপেক্ষা দীর্ঘ হলে নাকি প্রতীক্ষা হয়ে যায়। আমরা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকরের প্রতীক্ষায় আছি। এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় আরিফ জেবতিক এর একটি ফেসবুক স্টাটাস দিয়ে শেষ করছি-
এক রিকশাওয়ালা প্রতিদিন দুপুরে খেতে বসেই নানা ছুঁতোয় বউকে পেটাতো। বউ বেচারি আর কী আর করবে, সে তাঁর নিয়তি মেনেই নিয়েছিল। তো, একদিন রিকশাওয়ালার মুড খুব ভালো। সে ভাত খেলো, উঠে পান খেলো, একটা বিড়িও ধরালো, কিন্তু বউকে কিছু বললো না। এভাবে ঘন্টাখানেক পরে রিকশাওয়ালা দেখে, বউ সামনে ঘুরাঘুরি করে। সে মিষ্টিস্বরে বলল-
‘কী রে, কী হয়েছে?’
বউ মুখ ঝামটা দিয়ে বলল-
‘পিটাও তো পেটায়া ফেলো। গোসল করবো, ভাত খাব-কতো কাজ ওদিকে পড়ে আছে...!’
পুনশ্চঃ কামারুজ্জামানরে ঝুলাইলে ঝুলাইয়া দেন, স্যার। পাবলিকের আরো অনেক কাজ পড়ে আছে।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর, nayonshakhawat@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৫
জেডএম/