পৃথিবীর এই প্রান্তে যখন রাতের খাবার শেষে বিছানায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রায় সবাই, ঠিক সেই সময়টাতে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের এক শ্যামল ভূমিতে, নিজের জান বাঁচানোর জন্য বনপোড়া হরিণীর মতো ঘাস মাড়িয়ে প্রাণপনে ছুটে চলেছে এক আহত, আতংকিত এবং রক্তাক্তযুবক। তাকে ধাওয়া করে আসছে মৃতুর মতো কালো পোশাক পরা চার যমদূত।
যে ভয় এবং আতংক, যে দুঃশ্চিন্তা এবং দুঃস্বপ্ন তাকে প্রতিনিয়ত জাগিয়ে রাখতো রাত্রিবেলায়, আজ তার সব কিছুই বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। বিকারহীন এক অসহায় প্রতিবাদহীনতায় সে মেনে নেয় তার এই নিষ্ঠুর এবং অনিবার্য নিয়তিকে। ভুল সময়ে, ভুল মানুষদের মাঝে জন্মানোটা শুধু অপরাধই নয়, বিশাল এক পাপও বটে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেই সে আজ অকালে বিদায় নিচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে, তার প্রিয়মাতৃভূমি থেকে, তার প্রিয়তম কমলালেবুর সুবাসমাখা আদিভূমি থেকে। এই বিদায়ে অনন্ত আক্ষেপ আছে, আছে অনন্ত জিজ্ঞাসা, নেই শুধু অন্তিম সময়ের করুণ আর্তনাদ এবং অষ্ফুট বিলাপ।
মাত্র আড়াই মাস আগে যখন বইমেলা থেকে ফেরার পথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে জনারণ্যে নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক ও যুক্তিবাদী মানুষ অভিজিৎ রায়কে, তখনই শোকের সাথে সাথে অনন্তের শিড়দাঁড়া দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গিয়েছিলো। শুধু অনন্তের একারই নয়, এই অনুভূতি হয়েছিলো সকল বাংলাদেশি যুক্তিবাদী লেখকেরই। এরপর মাত্র একমাসের মাথায় যখন দিনে দুপুরে অসংখ্য মানুষের সামনে চাপাতি দিয়ে কোপানো হলো, হত্যা করা হলো ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে, তখন সেই ভয় রূপান্তরিত হলো প্রবল আতংকে। সেই আতংকে কেউ কেউ লেখা ছেড়ে দিয়েছে, কেউ কেউ ছদ্মনামের আড়ালে চলে গেছে, আবার কেউ বা প্রবল ঔদাসিন্যে অনিয়মিত হয়ে গেছে লেখালেখির জগতে।
অনন্তও এর ব্যতিক্রম কেউ না। অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যা পরবর্তী আতংকে আক্রান্ত হয়েছিলো সেও। জানতো, সে নিজেও নিরাপদ নেই এই ঘূর্ণিময় অশান্ত সময়ে। সে কারণে নিজেকে যতোখানি পারা যায় গুটিয়ে এনেছিলো সে। এক প্রকার পলাতক জীবনই যাপন করছিলো সে। কিন্তু, এই জীবনতো কোনো মানুষের নয়। প্রতি মুহুর্তে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ভয় আর আতংক নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায় না। কাজেই, অনন্তও স্বাভাবিকভাবেই চেষ্টা করছিলো যত দ্রুত সম্ভব বিদেশে চলে আসার জন্য। এতে করে প্রাণপ্রিয় দেশ হারাবে সে, হারাবে প্রাণের প্রিয় বাবা-মা, ভাই-বোনকে, তারপরেও তো অন্তত স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিতে পারবে, পারবে মুক্ত বাতাসে মুক্তভাবে বেঁচে থাকতে। এই ভাবনা থেকেই বাইরে চলে আসার জন্য জোর চেষ্টা নিয়েছিলো সে। নানা জায়গায় লেখালেখি করেছে এর জন্য। নানা লোককে বলেছে সুপারিশপত্র লিখে দিতে। এর মধ্যেও আমিও একজন।
অনন্তর হয়ে মুক্তমনার মডারেটর হিসাবে ইন্টারন্যাশনাল হিউমানিস্ট এন্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের(IHEU)ডিরেক্টর অব কম্যুনিকেশনস বব চার্চিলকে একটা সুপারিশনামা লিখেছিলাম আমি। সেখানে উল্লেখ করেছিলাম যে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সে বাংলাদেশে থাকা অত্যন্ত অনিরাপদ বোধ করছে এবং নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা গোপন স্থানে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আইএইচইইউ যেনো তার জন্য কিছু করে, যাতে সে দেশ ছেড়ে পশ্চিমা বিশ্বের নিরাপদ এলাকায় চলে আসতে পারে। আইএইচইইউ আমাকে আশ্বস্ত করেছিলো এই বলে যে, তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে যতোটুকু আছে, ততোটুকু তারা করবে। আমার এই সুপারিশপত্রের কথা জানতে পেরে দারুণ খুশি হয়েছিলো অনন্ত। আমাকে একটা ব্যক্তিগত মেইলে লিখেছিলো, “ফরিদভাই, বব চার্চিলকে মেইলটি পাঠানোর জন্য আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছিনা। জানিনা, আমার আবেদন IHEU এক্সেপ্ট করবে কিনা আদৌ, কারণ এখানে খুবই সীমিত সংখ্যক কোটা রয়েছে আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেই সহস্রাধিক আবেদন জমা পড়ে IHEU-এর কাছে। তথাপি চেষ্টা করছি। এখন দেখা যাক কী হয়। “
এই দেখা যাক এর চুড়ান্ত পরিণতি এখন কী হয়েছে, তাতো আমরা সকলে দেখতে পাচ্ছি। চেষ্টা, অপেক্ষা সবকিছুর অনেক উর্ধ্বে সে এখন চলে গিয়েছে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে।
অথচ, এই ছেলেটাই কী অসীম সম্ভাবনা নিয়েই না শুরু করেছিলো। মুক্তমনার একেবারে প্রথম দিকের লেখক সে। মাত্র ঊনিশ-বিশ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে সে তখন। বয়সে বাচ্চা হলেও লেখালেখিতে বিন্দুমাত্র তার ছাপ ছিলো না কোনো। খুবই পরিণত এবং খুবই গুরুগম্ভীর তথ্যবহুল লেখা লিখতো সে। এধরনের লেখা লিখবার জন্য অনেক ধৈর্য, পরিণত মস্তিষ্ক আর প্রচুর পড়াশোনার প্রয়োজন। এতো অল্প বয়সে এগুলো সে কীভাবে অর্জন করেছিলো, সেটা এক বিস্ময়ই ছিলো আমাদের জন্য।
শুধু লেখালেখি নয়, একই সময়ে সে যুক্তিবাদ প্রসারের জন্য মাঠেও নেমে পড়ে সে। নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে অন্যতম একটা কাজ ছিলো ‘যুক্তি’ নামের ষান্মাসিক একটা অসাধারণ মানের প্রগতিশীল পত্রিকা বের করা। এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলো সে। ‘যুক্তি’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন কীরকম অসাধারণ মানের একটা পত্রিকা ছিলো সেটি। সমস্ত ধরনের অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলো যুক্তি। অনন্তর এই সমস্ত যুক্তিবাদী কর্মকাণ্ড এবং মুক্ত-চিন্তাকে সমাজের সর্বস্তরে সরিয়ে দেবার প্রচেষ্টাকে সম্মান জানানোর জন্য ২০০৫ সালে মুক্তমনা তাকে ৠাশনালিস্ট পুরস্কার দেয়।
এরকম একজন মেধাবী যুবককে, যার দেশকে, সমাজকে দিয়ে যাবার কথা ছিলো অসংখ্য কিছু, কয়জন ঘাতকের চাপাতির আঘাত নিয়ে বিদায় নিতে হলো অকালে। অনন্ত শুধু একা নয়, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের সেরা মানুষগুলোকে বিদায় করছে মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় রায়, মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বাড়ছেই।
বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, সেটা এবং এইসব হত্যাকাণ্ডকে সরকারের তেমনভাবে গুরুত্ব না দেবার প্রবণতা, এই দুইয়ে মিলে, একদিন আমাদেরকে জাতি হিসাবে পঙ্গু করে দেবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, অসংখ্য মৌলবাদী জঙ্গি দেশের কোনো কাজেই আসবে না। কিন্তু যে মানুষগুলোকে এরা মুরগি কাটার মতো করে কেটে ফেলছে, তারা সবাই একেকজন সোনার টুকরো মানুষ। অকাল এবং অপঘাত মৃত্যুর কারণে শুধু এরাই যে হারিয়ে যাবে তাই নয়, মুক্ত-চিন্তার জায়গাটাতে ভবিষ্যতে আর কেউ আসতেই সাহস করবে না। আলোর শেষ রশ্মি নিভে যাবে, অন্তহীন এক অন্ধকার জগতে পতিত হবে দেশ এবং জাতি। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে আমাদের হয়তো অপেক্ষায় থাকতে হতে পারে কয়েক যুগ, কয়েক শতাব্দী। মৌলবাদীরা ঠিক এই কাজটাই করতে চাইছে আমাদের সমাজটাকে নিয়ে। আলোর দেখে দূরে সরিয়ে নিয়ে, পিছন দিয়ে হাঁটিয়ে, নিয়ে যেতে চাইছে অন্ধকার কোনো ভূবনে।
অনন্তর মতো যুবকেরা যে অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে আসে আমাদের জন্য, তাকে পরম মমতায় কাজে লাগানো উচিত আমাদের। আমাদের উচিত তাদেরকে এমন একটা নির্ভাবনাময় পরিবেশ দেওয়া, যেখানে তারা সতত ফুল হয়ে ফুটতে পারবে। তার বদলে যদি এদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সুযোগ দেই, তবে অনন্ত আক্ষেপে পোড়া ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এই অনন্তর ক্ষেত্রে আক্ষেপে পুড়েছি আমরা, আত্মগ্লানিতে ভুগেছি, আত্মাহুতী দিয়েছি। আর যেনো কখনো এমন আত্মাহুতী আমরা না দেই, সেই প্রতিশ্রুতি থাকুক আজ এ’বেলায়।
লেখকঃ মুক্তমনার মডারেটর
বাংলাদেশ সময় ২০১৫ ঘণ্টা, মে ১৪, ২০১৫
এমএমকে