মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আজীবন নির্যাতিত, নিপীড়িত হতদরিদ্র গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছেন। তার রাজনীতি ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে।
ফারাক্কায় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীকে অবমুক্ত করার সুমহান লক্ষ্যে তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল “ফারাক্কা লং মার্চ’’। মওলানা ভাসানী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন না। তিনি খেটে খাওয়া মানুষের নেতা হিসেবে সাধারণ মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত শাশ্বত অধিকার যে হরণ করেছে তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।
মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে “ফারাক্কা লং মার্চ”। আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের পরিবেশ, কৃষি ও জীব বৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। মওলানা ভাসানী ১৯৭৪ সাল থেকেই ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং জনমত গড়ে তোলেন।
১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের উপর ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে তার “ফারাক্কা লং মার্চ” কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করে একটি পত্র প্রেরণ করেন।
মওলানা ভাসানীর প্রেরিত পত্রের জবাবে ইন্দিরা গান্ধী লেখেন-“এটি ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও বেদনাকে একই ভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি বর্তমানে আমাদেরকে এত বেশী ভুল বুঝেছেন, এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর পত্র প্রাপ্তির পর মওলানা ভাসানী পুনরায় ইন্দিরা গান্ধীকে লিখেছিলেন, আপনার ৪ মে এর পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে আমার এরূপ প্রত্যাশা ছিলনা।
“ফারাক্কা সম্পর্কে আমি আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সফর করে আমাদের কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা নিরুপণ করার জন্য। আমি আপনাকে সরকারি কর্মকর্তাদের রিপোর্টের উপর আস্থা স্থাপন না করার অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ এগুলো প্রায়ই বিদ্যমান অবস্থার প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন নয়।
পারস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানে আপনার পথকে আমি প্রশংসা করি। তবে সমস্যার ব্যাপক ভিত্তিক স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দু’মাসের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বণ্টন ভিত্তিক হওয়া উচিৎ”।
এ পত্রেই মওলানা ভাসানী উল্লেখ করেন, যদি তার অনুরোধ গ্রহণ করা না হয়; তবে তিনি নিপীড়িত জনগণের নেতা ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব পুরুষগণ এবং মহাত্মা গান্ধীর প্রদর্শিত পথেই সংগ্রাম পরিচালনা করবেন। যে কথা সে কাজ। মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন, ১৬ মে (১৯৭৬) রাজশাহী থেকে “ফারাক্কা অভিমুখে লং মাচর” শুরু করবেন।
তিনি লং মার্চের প্রস্তুতির সময় বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এ সম্পর্কে অবহিত করে বার্তা পাঠান। জাতিসংঘের মহাসচিব ড. কুট ওয়ার্ল্ডহেইম, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ড, গণচীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কুসিগীন প্রমুখ নেতৃবন্দের কাছে বার্তা প্রেরণ করে ভারতের উপর তাদের প্রভাব প্রয়োগ করে গঙ্গার পানির সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির সহযোগিতা কামনা করেন।
মওলানা ভাসানীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ লোক লং মার্চে অংশ গ্রহণ করার জন্য রাজশাহী শহরে এসে সমবেত হয়। মওলানা ভাসানী তখন পিজি হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর প্রসট্রেট গ্ল্যান্ডের সমস্যাসহ তিনি ভীষণ জ্বরে ভূগছিলেন। হাসপাতাল থেকে তাঁকে রাজশাহী নেওয়া হলে শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হল। কিন্তু মওলানা সাহেব দমবার পাত্র নন।
তিনি ঘোষণা করলেন, “লং মার্চের” মিছিল রাজশাহী থেকে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সেখান থেকে কানসাট অতিক্রম করবে। লং মার্চের মিছিল শুরু হয়ে যথারীতি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কানসাট পৌঁছুল। সেই বিশেষ সময়টিতে মওলানা ভাসানীর অনবরত প্রশ্রাব নির্গত হচ্ছে, তিনি খুবই অসুস্থ। একরকম সংজ্ঞালুপ্ত অবস্থায় তিনি মাইক্রোফোনের সামনে দুজন লোকের কাধে ভর দিয়ে বজ্রকঠোর ভাষায় দীর্ঘ সময় বক্তৃতা করলেন। লং মার্চে অংশ গ্রহণকারীরা এটাকে আশ্চার্য ঘটনা বলে মনে করেন।
তিনি অনবরত বললেন, গঙ্গার পানিতে আমাদের ন্যায্য অধিকার, এটা আমাদের প্রাকৃতিক অধিকার, এ অধিকার পশু, পাখি, গাছপালা, কীটপতঙ্গ প্রাণবান সব কিছুর জন্মগত অধিকার । এ অধিকার হরণ করার ক্ষমতা কারো নেই। যে হরণ করেছে সে, প্রাণের বিরুদ্ধে জুলুম করেছে। বাংলাদেশের প্রাণবান মানুষ কোন দিন তা মেনে নেবে না। তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন আল্লাহ নিশ্চয় আমাদের বাঁচার পথ করে দেবেন।
ভেবে অবাক হই মওলানা ভাসানীর আগে কোন রাজনৈতিক নেতা বা কোন পরিবেশ বিজ্ঞানী আমাদের জাতীয় জীবনে ফারাক্কা বাঁধের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ সম্পর্কে আলোকপাত করেননি।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৩৯ বৎসর পূর্বে জাতির প্রাণপুরুষ মওলানা ভাসানী যে ডাক দিয়ে গেছেন আজও আমরা তা আদায় করতে পারিনি। আমাদের অর্ধেক লোকের জীবন মরণ ফারাক্কার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের জাতীয় জীবনে এমন একটা সংকট, এত বড় অন্যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আর কত দিন চোখ বুঝে সহ্য করবেন।
ফারাক্কা লং মার্চে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এখনো ফারাক্কা লং মার্চের কথা মনে পড়লে মানসপটে ভেসে উঠে, এক দিকে ফারাক্কা বাঁধ আরেক দিকে শুকনো নদী, বালু চরে লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে বক্তৃতারত মওলানা ভাসানীর ছবি।
মহান নেতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার লক্ষে ভাসানী অনুসারী পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে। বহুমাত্রিক মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন, তাঁর অভিজ্ঞতার রতœ ভান্ডার সংগ্রামী জীবন ও কর্মকে আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
লেখক: মহাসচিব, ভাসানী অনুসারী পরিষদ
বাংলাদেশ সময়: ২০২১ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৫
জেডএম/