এই তো সেদিনের কথা; বাংলাদেশে টিভি দেখা হারাম ছিল। বৈদ্যুতিক আলোয় পড়ালেখা করলে চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করা হতো।
রেলগাড়িতে চড়লে পুরুষের ক্ষয়রোগ হবে বলে এক ধরনের বিশ্বাস ছিল, কলেরার মতো মহামারী রোগ যাতে গ্রামে আসতে না পারে, সে জন্য রাত জেগে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পাহারা দেয়া হতো। এখনো কেউ কেউ নানা রকম অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারে ভোগেন। এই অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারেরও জন্ম-মৃত্যু আছে।
নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, ভাবছেন- মানুষ মরণশীল, কিন্তু তার বিশ্বাস অমর। সেই বিশ্বাস যে রকমই হোক। আসলে তা ঠিক নয়; কুসংস্কারের মৃত্যু আছে। এক সময়ের রাজ-রাজারা ক্ষরা জর্জরিত এলাকায় পানির সংকট মিটানোর জন্য বিরাট দীঘি খনন করতেন; সেই দীঘিতে পানি না উঠলে সতী এক কুমারী মেয়েকে বলীদান করা হতো, এখন আর কাউকে বলীদান করা হয় না।
এক সময় বিধবা বিবাহ নিষেধ ছিল; এখন আর নিষেধ নেই। আইয়ামে জায়েলিয়াত যুগের অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর কুসংস্কার মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) আরব্য সমাজ থেকে চিরতরে ধুয়ে মুছে ফেলেছেন। এই তো সেদিন বাংলাদেশে কম্পিউটারকে কাঁচের ঘরের মধ্যে রেখে সবাই সেখানে জুতা-স্যান্ডেল খুলে প্রবেশ করতো। এখন আর তা করে না। কলেরা হলে এখন মানুষ খাবার স্যালাইন খায়। রেলগাড়ি কিংবা বৈদ্যুতিক বাতির ব্যাপারে এখন আর কারো ভুল বিশ্বাস নেই।
তার মানে অনেক অন্ধবিশ্বাস মারা গেছে। ভবিষ্যতে আরো মারা যাবে। যেমন, ব্লগার মানেই নাস্তিক নয় কিংবা নাস্তিক মানেই ব্লগার নয়। আমরা যত মানুষকে জোব্বাপরা দেখি তারা সবাই কি প্রকৃত ধার্মিক? তাহলে বাংলাদেশে এতো অন্যায়, এতো দুর্নীতি কিভাবে হয়? তার মানে জোব্বাপরা সবাই প্রকৃত ধার্মিক নয়।
এখন থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগেও আমি পাঞ্জাবিপরা নাস্তিক মানুষজন দেখেছি। তখনকার সময়ে কম্যুনিস্টদেরকে নাস্তিক বলা হতো। এখন যেহেতু বাংলাদেশে কম্যুনিস্টদের খুব একটা ‘খাওয়া নেই’, তাই তাদের নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই।
এখনো যারা শুধু ব্লগ কিংবা ব্লগারদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত আছেন, তাদের জন্য বলছি। ব্লগিং মানেই নাস্তিকতার চর্চা নয়। কারণ ফেসবুকও এক ধরনের ব্লগ। কিন্তু অনেকেই তা জানেন না। এখন ব্লগিং এবং ফেসবুকিং এর মাধ্যমে দীন ইসলামের চর্চাও হচ্ছে। সুতরাং ব্লগার মানে একজন ইমানদার ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষকও হতে পারেন।
আজকাল ফেসবুক পেজেও অনেক রকম আড্ডার আয়োজন হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, শেয়ারিং চলছে। এমনকি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি চিন্তাবিদ, মুফতি ও গবেষকরাও হাদিস-কোরানের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আলাপ-আলোচনা করছেন। কেউ প্রশ্ন করেন, কেউ উত্তর দেন।
অথবা যার যা জানতে ইচ্ছে করে সে জানতে চায়, যারা সঠিক উত্তর জানে তারা ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর জানা না থাকলে পরে জানানোর চেষ্টা করা হয়। এই ধরনের আড্ডায় অংশ নিতে খ্যাতিমান কিংবা মহাজ্ঞানী ব্যক্তি হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমরা যে কেউ যে কারো সাথে যেমন আড্ডা দেই, ব্যাপারটি ঠিক তেমনই। কারণ দিন বদলে গেছে। ফেসবুকের গ্রুপ পেজও আজকাল মতামত শেয়ারিংএ বেশ জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
বাংলা ভাষায় ফেসবুকের বিভিন্ন রকম গ্রুপ পেজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে MALE CHAPTER। কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এটা আবার কি? এরা কি করে? এখানে কি শুধু পুরুষরাই আলাপ-আলোচনা করে? এখানে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই।
এখানে দারুন সব পোস্ট শেয়ার করা হয়। কারো অনুভূতিতেই আঘাত করা কিংবা কাউকেই দুঃখ দেয়ার মতো কোনো পোস্ট এখানে দেয়া হয় না। আমি অনেকদিন ধরে এই পেজের একজন পাঠক এবং ফলোয়ার। এই পেজের পক্ষ থেকে কফি হাউজের অথবা বিউটি বোর্ডিং এর হারিয়ে যাওয়া আড্ডাকে ভার্চুয়াল জগতে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় লেখক-কবি-চলচ্চিত্রকার ও নানা পেশার সৃজনশীল মানুষের সাথে দেখা হবার; গল্প করার; আর একটু একটু করে সভ্যতার নবজাগরণের আলো খোঁজার নতুন একটি আনন্দগৃহ তৈরি করেছে। তারা মাঝে মাঝেই এপার বাংলা-ওপার বাংলার খ্যাতিমান কিংবা উদীয়মান কবি, লেখকদেরকে নিয়ে আড্ডা’র আয়োজন করেন। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা। এক কথায় চমৎকার।
কিছুদিন আগে কলকাতার সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন। বাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাতি আর বাদল দিন হলে তো কথাই নেই। সঙ্গত কারণেই আমি এতে যোগ দেই, ভীষণ উপভোগ করি। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, মনের মিল আছে এমন মানুষের সাথে আড্ডায় মেতে উঠি। আর যারা লেখালেখি করেন তারা বিউটি বোর্ডিং এর আড্ডার কথা কে না জানেন?
আড্ডা প্রেরণাদায়ী, চিন্তার খোরাক যোগায়। তাই হয়তো বিদেশ-বিভূঁইয়েও আড্ডাটা ছাড়তে পারিনি। সময় পেলে MALE CHAPTER এর ওয়ালে কাব্যিক ভাষায় লিখি, ‘...আর...হ্যাঁ...তোমার… ঝুমবৃষ্টি পেয়েছি। …নীলছাতা আর একগুচ্ছ কদমফুল পাঠালাম, পেয়েছো কি না জানিও…’।
মোদ্দাকথায় আমি বলতে চাচ্ছি, ফেসবুকার কিংবা ব্লগার সম্পর্কে আর নেতিবাচক ধারণা নয়। যে কেউ ব্লগার হতে পারেন। ব্লগে, ফেসবুকে আপনি নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। মতামত শেয়ার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনি হতে পারেন একজন ঈমানদার মুসলিম, ঈহুদি ধর্মযাজক, খ্রিস্টান পাদ্রী, চিত্রপরিচালক, ব্যবসায়ী, দাঁতের ডাক্তার, সত্যানুসন্ধানী কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক লেখক। যে কাউকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেই নাস্তিক নাম ছড়িয়ে দেয়াটা আমাদের সমাজকে এক ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। রক্তের গঙ্গায় কখনই শান্তির বাতাস বইবে না।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, nayonshakhawat@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
জেডএম/