শিক্ষক মহান। একটি জাতি শিক্ষকের দীক্ষায় সমৃদ্ধ হয়, সামনে এগোয়।
বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা এখন বেশ পরিব্যপ্ত, বিস্তৃত। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী বেড়েছে। শিক্ষার প্রতি সরকার ও জনগণ সবাই সচেতন হচ্ছে, হয়েছে। কিন্তু যে হারে শিক্ষার্থী বেড়েছে, সে হারে শিক্ষক বাড়েননি। সবচেয়ে ভয়াবহ হল এত বাড়ার মধ্যেও যেটি কমেছে সেটা হল শিক্ষকের মর্যাদা। কীভাবে, কখন এ সংকট তৈরি হয়েছে সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু আপাত সত্য হল পরিসংখ্যানগত শিক্ষার কাছে মানসম্মত শিক্ষা মার খেয়েছে, শ্রেণিকক্ষে এটা সহজেই টের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী আগের মতো শক্ত ভিত্তি নিয়ে বড় হচ্ছে না। যা নিয়ে আসছে তা যতটা না মগজে তার চেয়ে বেশি কাগজে। ওখানে জিপিএ লেখা থাকে। সেটা দিয়ে শিক্ষার্থীর অবস্থান বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু মান পরিমাপ অসম্ভব।
এই যে বিপর্যয় এটা শুধু বিদ্যাশিক্ষার নয়, মন এবং মানসিকতারও। মানবিক ও মানসিক অচেতনভাবে একটি সমাজ যদি গড়ে উঠতে থাকে, শিক্ষক সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি, হচ্ছেও। অর্থমন্ত্রী সরাসরি বলেছেন, শিক্ষকরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অল্প সময়ে অধ্যাপক হয়ে যান, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-স্কেল বা পদমর্যাদা সচিবদের সমান হতে পারে না। কথা হিসেবে এটি সাধারণের চোখে সত্য মনে হতেই পারে, তিনি সেটিই বলেছেন। যা বললে শিক্ষক রাজনীতির অশুভ তৎপরতাকে ইঙ্গিত করা হয়, শিক্ষক নেতারা সহজেই ঝিমিয়ে পড়েন।
কিন্তু ঘটনা উল্টো। শিক্ষকরা অত্যন্ত সংবেদনশীল প্রজাতি হয়ে থাকেন। তাই তারা কষ্ট পেয়েছেন, ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। বেতন কমিটিতে সচিবদের পদমর্যাদা অসঙ্গতিপূর্ণভাবে বাড়ানোর ফলে শিক্ষকগণ যারপরনাই মর্মাহত। মুখ্য সচিব, সিনিয়র সচিব, সচিব ইত্যাদি কোনো অর্গানোগ্রাম মেনে করা হয়েছে বা এটা আদৌ আইনসিদ্ধ হয় কিনা ইত্যাদি প্রশ্নের কথা না হয় বাদ থাকলো কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদমর্যাদা সচিবদের নিচে নামিয়ে আনাটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে, কেউ মানছেন না। বরং তারা অপমানিত হয়েছেন। এ শিক্ষকদের কাছে পড়ে শুনে মানুষ হয়ে তারা আর শিক্ষকদের মানুষ মনে করছেন না। এদেরকে বলা হয় আমলা। ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র খুব জটিল মারপ্যাঁচের বিষয়, অসম্ভব লম্বা এর হাত, খুবই শক্তিশালী। শক্তি বিচারে শিক্ষকদেরঅনুরূপ কোনো তন্ত্র গড়ে ওঠে নাই ঠিক কিন্তু আত্মমর্যাদায় তারা নিজেদেরকে সুপিরিয়র ভাবতে এখনও ভুলে যান নাই। শিক্ষক তার মর্যাদাবোধ অটুট রাখবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সেই সম্মান নষ্টের পায়তারা যদি সরকারিভাবে হয়, বিষয়টি আতঙ্কের ও আশঙ্কার বটে।
শিক্ষক হতাশ হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশে কীভাবে ভূমিকা রাখবেন? শিক্ষক রুটি-রুজির জন্য অন্য চিন্তা করলে শিক্ষার্থীর প্রতি মনোযোগ কমে যাবে, স্বাভাবিক। সে প্রক্রিয়ায় যে জাতি গড়ে উঠবে, সেটা ভবিষ্যতে দেশকে কী উপহার দেবে?
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আবর্তিত হন, সেটা তো তার নিয়োগ প্রক্রিয়াই ঠিক করে দেয়। শুধু মেধা বা শিক্ষাদানের যোগ্যতার উপরই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বা পদোন্নতি পান, একথা সর্বাংশে সত্য নয়- অর্থমন্ত্রী এমনটিই বলতে চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়া বদল না করে শিক্ষকদের দোষারোপ করা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু কথা হলো একজন উপাচার্যই বা কে নির্বাচন করেন, শিক্ষকরা নিশ্চয়ই নন। তো তার মর্যাদা কে ঠিক করবেন? শিক্ষকরা চাকরির শেষে অধ্যাপক, উপাচার্য তো সবাই হবেন না। আর আমলারা চাকুরির শেষে সচিব, সিনিয়র সচিব, মুখ্য সচিব এমনতর ধারায় বিন্যস্ত হবেন কোনো বিবেচনায়। সেখানে কি কোনো রাজনীতির প্রভাব থাকে না? তবে ওএসডি কারা হন, কেন হন। আমরা কাউকে অমর্যাদা করতে চাই না, খর্ব করতে চাই না তাদের অবদান। দেশের সার্বিক প্রশাসন তারা সুচারুভাবে পরিচালনা করেন, করবেন-আমরা তো এমনভাবেই তাদের গড়ে তুলি। আমাদের কাছে শিক্ষালাভ করেই তারা আজ নিজেদের অবস্থান এত উঁচুতে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাদের অবস্থান তো আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের মর্যাদা বা সম্মান বিনষ্ট করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? কোন দৈব অনিষ্ট তাদের উপর ভর করেছে যে একজন অধ্যাপককে সচিবদের নিচে চার নম্বর সারিতে অবস্থান করতে হবে। শিক্ষকদের তো কারও সঙ্গে তুলনা চলেনা। শিক্ষক শুধু চাকরি করেন না, শিক্ষক গোটা জাতি গড়েন। তার অবস্থান হবে স্বতন্ত্র, সবার উপরে। তার মর্যাদা এবং বেতন স্কেলও হবে ভিন্ন, সেটা তো করা হলোই না বরং অন্যায়ভাবে চাকুরি শ্রেণিকরণে শিক্ষকদের অবস্থান অবনমন করার প্রস্তাব করে সচিব কমিটি গোটা জাতিকে অপমান করেছে। এটার বিচার হওয়া উচিত।
প্রশাসনের একজন ইউএনও পর্যন্ত পাজেরো জিপে চড়েন, আমরা নম্বরযুক্ত সিটি বাসে ঝুলে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। শিক্ষার্থীরা যদি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সন্তান হন বা ধনীর সন্তান তারাও গায়ে ঠাণ্ডা বাতাস ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করে ক্লাসে আসেন। আমরা ধুলোর সঙ্গে বসবাস করি, নিজেরা আত্মঅহঙ্কারের জোরে বাঁচি। সরকার বা প্রশাসন আমাদের সম্মান নিয়ে প্রহসন করে-এটাই কি এখন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ!
অথচ অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে যেখানে বৈষম্য থাকবে না, প্রগতির চর্চা হবে। এই যে শিক্ষক-আমলা শ্রেণিকরণ, এটা কি তবে বৈষম্য নয়? এটাই কি প্রগতি? আমাদের পোষাকে ময়লা ধরিয়ে ফকফকা পোষাক পরে তবে কারা ঘুরে বেড়াবে, সেটা কি হতে পারে বা হতে দেয়া যায়? উত্তর একটাই- না।
তাই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকরা বুকের ভেতর কষ্ট পুষে আজ ক্ষোভের মশাল নিয়ে একত্রিত হচ্ছেন, নিজেদের অধিকারের কথা সরকারকে জানান দিচ্ছেন। ধারাবাহিক আন্দোলন, মিছিল, কর্মবিরতি শুরু করেছেন। শিক্ষক নেতরা তো বটেই সাধারণ শিক্ষকরাও মতভেদ ভুলে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন, শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাকর একটি পৃথক বেতন স্কেল গঠন করুন। মনে রাখবেন শিক্ষকদের সমাজের প্রতিটা মানুষ সম্মান করেন। স্যার সম্বোধন করেন, অন্য কোনো পেশায় এরকম সর্ব জনাব উপাধিতে ডাক পাওয়া অসম্ভব। আমরা সেটাই পাই। পাই বলেই আপনাদের জানাই-হয়ত আপনার অসাবধানতাবশতঃ আমাদের অবস্থান নিয়ে টানাহেঁচড়া করছেন, অজ্ঞানতাবশতঃ নিশ্চয়ই নয়। আমরা তাই চাই আপনাদের সম্বিৎ ফিরুক। আপনারা একটু সংবেদনশীলভাবে বিষয়টা দেখেন। এটা আমাদের দাবি, আমাদের অধিকার। এমনি এমনিই দিতে বলছি না, তাহলে তো আর সম্মান থাকে না।
সমাজটার কথা একবার ভাবুন- সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? কিছুদিন আগেও পাড়ার ছেলেরা খেলছে, সেখানে বড় ভাই বা সিনিয়র এসে একটা ডাক দিলে তারা এক দৌড়ে পালাতো। এখন গুলি আর চাপাতির খেলা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই শুধু নন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ সব শিক্ষকরাই এই মূল্যবোধ সম্পন্ন সুস্থ সমাজ গড়ার নিপুণ কারিগর। কারিগরের উপযুক্ত বেতন না দিয়ে, তাকে অসম্মান করে একটা প্রকৃত মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি তৈরি হওয়া অসম্ভব।
কাজেই একটা সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন বুকে লালন করে স্বাধীনতার বীজ বপনের মাধ্যমে একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ গঠন করতে পারলেই ফুলে ফলে শক্ত মহীরুহ হয়ে উঠবে দেশ, সভ্যতায় আমাদেরনাম থাকবে, থাকবে উন্নত অবদান। সে নামটিকে রহিত করবেন না, প্লিজ।
বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের কথা উদাহরণ হিসেবে যদি নাও আনি পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কথা বিবেচনা করুন। সেখানে শিক্ষকদের বেতন, মান অতুলনীয়। আমরা কথায় কথায় বিদেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে শান্তি পাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবার হরিজনের মর্যাদা যদি দিতে চাই, বিষয়টা ঠিক যায় না।
শুনেছি ডেপুটেশনে সরকারি প্রশাসনের কোথাও নিয়োগ পেলে আমলারা যদি শিক্ষকদের অধীনস্থ হন, এ ভয় আমলাদের গ্রাস করেছে। এটা তারা না মেনে নিতে পারেন, না মনে। তো এসব জটিল মনো-দৈহিক শক্তি প্রয়োগ জনিত সমস্যা অনুধাবন করে জোরপূর্বক অন্যায়ভাবে চাকরির অর্গানোগ্রাম ভেঙে নিজেদের জন্য উঁচু থেকে উঁচু পদ তৈরি করে স্ব-আসন সুসংহত করার চেষ্টা করেছেন। আর নিজে প্রভু হলে অন্যকে দাস বানাতে হয়, এ ঔপনিবেশিক চিন্তায় শিক্ষকদের সারি অনেক পেছনে রেখেছেন। এটা যে তাদের ইচ্ছাকৃত দোষ এমনটা নয়- এটা উপনিবেশিক মানসিকতার ফল, কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। তাই কাজটি সরকারকেই করতে হবে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে এটি বিবেচনা করবেন, প্রত্যাশা। আর না হলে শিক্ষকদের মনোকষ্ট হয়ত আমলাদের উপর থাকবে কিন্তু সংক্ষুদ্ধ হবেন বা আন্দোলন করবেন সরকারের বিরুদ্ধে। সেটা সময় হিসেবে এখন হতে দেওয়া উচিত হবে না।
কারণ মৌলবাদী কোনো সরকার থাকলে না হয় রাস্তায় নামাটা যৌক্তিক ছিল, কিন্তু এতবড় প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সরকার, ঠিক সেসময় শিক্ষকরা পেটের জন্য রাস্তায় নামলে সরকার লজ্জা পাবেন না!
ইতোমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছে সরকার, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়েছেন প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা- সব প্রশংসনীয়। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি সরকার আরও গুরুত্ব দেবেন- এই প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। আমরা সরকারের সেই স্বাভাবিক পদক্ষেপগুলোর প্রত্যাশা করি-বেশি কিছু নয়।
তাই আমরা চাই সরকার সমব্যাথী হোক, শিক্ষকদের জন্য পৃথক মান-মর্যাদা নির্ধারণ করুক। শিক্ষকরাও আরও সজীব হোক; গড়ে তুলুক সুন্দর জাতি, সবুজ এবং সমৃদ্ধ দেশ।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Email: razib.mir@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৫
এসএইচ /