কাউকে বই ধার দিও না। বই ধার নিলে কেউ আর তা ফেরত দেয় না।
তখন নিম্নমাধ্যমিকে পড়ি। আনাতোল ফাঁ’র এই উক্তি আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিলো। তখন সবে বুঝতে শিখেছি, সমাজকে উদ্ধার করতে লাইব্রেরির বিকল্প নেই। কিন্তু হাতে বই কেনার পয়সা নেই। আনাতোল ফাঁ ঠিক সেই সময় আমার কাছে এলেন। বন্ধু-বান্ধবের কিছু বই এনে জমিয়ে ফেলেছি। অল্প ক’দিনেই লাইব্রেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি খুব খুশি মনে দিন কাটাচ্ছি। এর মধ্যে তারা সবাই এসে একদিন যার যার বই ফেরত নিয়ে গেলো।
এরপর বই ধারের ধান্দা বাদ দিলাম। এবার সরাসরি বই চুরিতে মন দিলাম। চুরি সহজ কাজ নয়। কিছু নিয়ম-নীতি আছে। তন্ত্র-মন্ত্র আছে। চৌর্যমন্ত্র খুঁজে বের করলাম। সিধ রয়েছে সাত প্রকার। চুরির জন্য লিখিত মন্তর আছে। তালা খোলার মন্তর, দরজা খোলার মন্তর- সব আলাদা আলাদা। পড়ালেখা করে জানলাম, চুরি একটা শাস্ত্রীয় বিদ্যা। আমি বই চুরি করে লাইব্রেরি গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
দূর সম্পর্কের এক মামার একটি বই চুরি করলাম। মাঝারি সাইজের বই। দু’চার লাইন পড়লাম। অখাদ্য। পাথর চিবিয়ে রস বের করা যায় কিন্তু এই বই থেকে কিছু বেরুবে না। বইয়ের নাম ছিল, ‘সমকালের চোখে হুমায়ূন আহমেদ’।
হুমায়ূন আহমেদ নামটির সঙ্গে এভাবে আমার পরিচয়। এরপর হুমায়ূন সাহিত্যের প্রেমে পড়েছি। হাবুডুবু খেয়েছি। হুমায়ূন সম্পর্কে জেনেছি। যেমন- হুমায়ূন আহমেদ যৌবনে কখনো প্রেমে পড়েনি। ‘ভালোবাসি’ বলেননি কাউকে।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্লাস ফোরে পড়েন। সেই সময় ‘এক বৃন্তে দুই ফুল’ নামে একটি বই পড়ে জানতে পারেন প্রেম একটি স্বর্গীয়, মহৎ এবং উচুস্তরের ব্যাপার। তিনি তার সদ্যলব্ধ জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগালেন। পাশের বাসার পরী নামে এক বালিকাকে ডেকে কাঁঠাল গাছের নিচে নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন, পরী, আমি তোমাকে ভালবাসি। পরী চোখ বড় বড় করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, তুই অসভ্য।
মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না। কাজেই শিশু হুমায়ূন আহমেদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়। শৈশবের এই ঘটনার কারণেই তার পরবর্তী জীবনে কোনো তরুণীকে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এই কথা বলা হয়নি।
এই ট্র্যাজেডি শুধু হুমায়ূন আহমেদের জীবনেই নয়, অনেকেরই ঘটেছে। একই ট্র্যাজেডিতে পড়ে আমারও কাউকে ভালোবাসি বলা হয়নি। আমি মক্তবে বসে পবিত্র মনে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বালিকার কানে সেটা পৌঁছানোর আগে হুজুরের কানে পোঁছে গিয়েছিলো। এমন ‘অশ্লীল, কুরুচিকর, অশ্রাব্য’ শব্দ ব্যবহারের শাস্তি একটাই- বেত মারা হবে। হুজুর তৎক্ষণাৎ পিটিয়ে শাস্তি কার্যকর করলেন। পিটুনিতে ক্ষুদ্রকায় প্রেমিকের কৃষ্ণকায় নিতম্ব ক্ষণিকেই লাল হলো। লজ্জায় আমিও লাল হলাম। ছোটবেলায় মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া লজ্জা, এখনো কাজ করছে। এরপর ভালোবাসার নাম মুখেও আনিনি।
‘ভালোবাসা’ শব্দটিকেও ভুলভাবে জ্ঞান করেছি। তাই শুধু রাগ নয়, কাউকে ভালোবাসাটুকুও দেখাতে পারিনি। নারী-পুরুষের মধ্যেই শব্দটিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। কখনো কেউ জানায়নি, ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে। ভালোবাসা হতে পারে পিতা-পুত্রের। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। বন্ধুর জন্য বন্ধুর। আমরা কদাচিৎ এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরষ্পরকে ‘ভালোবাসি’ বলে থাকি।
আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ভালবাসি’ শব্দটি অত্যন্ত নোংরা। এটা বলা যাবে না। বিশেষ একজন এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ ছাড়া কাউকে চিৎকার করে বলতে পারিনি- আমি তোমায় ভালবাসি। কিন্তু অনেককেই ভালবাসি। ভাই, বোন, বাবা, বন্ধু কাউকেই বলা হয়নি- ভালোবাসি।
মাকেও না। কখনোই উচ্চস্বরে ‘ভালবাসি’ শব্দটি উচ্চারণ করে সরাসরি বলা হয় না- মা, তোমাকে খুব ভালবাসি।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয়, আবেগের শব্দটিকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করে রেখেছি আমরা। আজব আমাদের রক্ষনশীলতা !!
লেখক: কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। ইমেইল: monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
আরএম