ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মেধা-ফুল বাঁচানোর যুদ্ধ

ডঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৬
মেধা-ফুল বাঁচানোর যুদ্ধ

ঢাবা: শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে “দুই মেধাবী কি দমে যাবেন” শীর্ষক সাম্প্রতিক একটি লেখায় সাড়া দিয়ে যারা এগিয়ে এসেছেন, সুমি আর কৃষ্ণের ভবিষ্যৎ সংরক্ষণের জন্য, তারা প্রশংসার দাবিদার। এ ধরনের রিপোর্ট অনুপ্রেরণাদায়ক, কারণ এর মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয় যে, আমাদের মাঝে সংবেদনশীল ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

তবে এরকম তরুণ-তরুণী যাদের শিক্ষা জীবন অকালেই শেষ হয়ে যায়, তাদের সংখ্যা অনেক। সারা দেশ জুড়েই। আমাদের প্রচেষ্টা হতে হবে সমাজ ব্যবস্থার সেই পরিবর্তনে যা আমাদের সবার শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করে। এটা বিশেষ সংবাদ পত্রের রিপোর্ট পড়ে শুধু কিছু হৃদয়বান মানুষের এগিয়ে আসার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না।

আজ আমার বন্ধু ও সহপাঠী আকবরের কথা মনে পড়ছে। প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগের কথা। ১৯৭৩ সাল নাগাদ সিরাজগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে নবম ক্লাশ পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলাম, যার পর ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজে স্থানান্তর হই। সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু ভালো স্কুল ছিল, যার মধ্যে ছিলো ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল। ১৯৭১ সালে যে এসএসসি পরীক্ষা হয় সেটাতে কৈশোরের আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবিরের বড় ভাই রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। সেই পরীক্ষা বাতিল হলে পরবর্তী বছর আবার পরীক্ষা হয় এবং সেটাতেও আগের বারের মতই ভিক্টোরিয়া থেকে তিনি মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।  
 
হাই স্কুলে প্রতি বছর সর্বোচ্চ স্থানের জন্য আমাদের প্রতিযোগীতা চলতো। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু কবির মোঃ আশরাফ আলম এবং আমার আব্বা দুজনেই ডাক্তার ছিলেন। কবিরের আব্বা সরকারী হাসপাতালে নিয়োজিত ছিলেন। আর আমার আব্বা সামরিক বাহিনীতে। কবিরের সাথে আমার জীবনের কত স্মৃতি বিজড়িত। আমরা বন্ধু হিসেবে একাত্মা হলেও ক্লাশে প্রতিযোগিতায় আমরা একে অপরকে ছাড় দিতাম না। তার পরও আমাদের প্রতিযোগিতা চলতো ক্লাশের দ্বিতীয় স্থান আর তৃতীয় স্থান নিয়ে। কোন বছর আমি দ্বিতীয় হতাম আরে কোন বছর সে। প্রথম স্থানটা আমরা কোন বারই দখল করতে পারিনি। সেটা আমাদের আরেক সহপাঠির জন্য। তার নাম আকবর।
 
সিরাজগঞ্জের পাশে এক গ্রামের ছেলে সে। সাধারণ কৃষকের ঘরের। তার হাতের লেখা ছিল যেমন অসাধারণ সুন্দর। মেধাও ছিল তেমনি।   কবিরের কথা মনে নেই, কিন্তু আমি স্কুলেরই একজন সম্মানিত এবং সফল শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট টিউশন নিতাম। আকবরের জন্য এসবের কিছু প্রয়োজন হতো না। ক্লাশের প্রথম স্থানটি সে যেন কেমন করে নিজের জন্য করে নিয়েছিল। আর কারো সেখানে স্থান নেই। কবিরের মত সে আমার ঘনিষ্ঠ ছিল না, কিন্তু সেও একজন সুহৃদ ছিলো।

১৯৭৩ সালে পারিবারিক কারণে ঢাকায় স্থানান্তরিত হলাম। কবির আরো পরে ঢাকায় আসে। আমরা দু জনেই ভিন্ন ভিন্ন বোর্ডের অধীনে ভালো ফল অর্জন করি। ১৯৭৬ সালের এইচ.এস.সি পরীক্ষায় আর্টস গ্রুপে আমি ঢাকা বোর্ডে তৃতীয় স্থান অধিকার করি। আমার বাল্যবন্ধু কবিরও রাজশাহী বোর্ডে ভালো রেজাল্ট করে। সেইদিন গুলো পেছনে রেখে আমরা অনেক দূরে এগিয়ে এসেছি। পরে আমি এবং কবির দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমি অর্থনীতিতে আর কবির জন প্রশাসনে।
 
পরবর্তীতে শিক্ষাকেই আঁকড়ে ধরে আরো অনেক এগিয়ে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছি। কবির চলে গেলো সিভিল সার্ভিসে। সে এখন বাংলাদেশের সিভিল প্রশাসনে একজন উচ্চ পদস্থ এবং স্বনামধন্য কর্মকর্তা। আবার কোন ফাঁকে পিএইচডি-টাও সেরে ফেলেছে। আসলে এই লেখাটি আমার অথবা ড. কবিরের ব্যাপারে নয়। বরং আমাদের সেই সহপাঠী আকবরকে নিয়ে। তবে আমাদের প্রসঙ্গে এটুকু বলতে হলো আকবরকে নিয়ে স্মৃতিচারণের পটভূমি হিসেবে।

যতদূর জেনেছি, যাকে আমরা ক্লাশের প্রথম স্থান থেকে কখনো সরাতে পারিনি সে এস.এস.সি পরীক্ষার পর দারিদ্রের কারণেই হোক অথবা একটি সাধারণ কৃষক পরিবারে বড় সন্তান হিসেবে হাল ধরার জন্যই হোক, সেখানেই তার শিক্ষা জীবন শেষ। এখনো আকবরের কথা মনে পড়ে। জানি না সে কোথায় আছে বা তার কি হোল। কিন্তু এটা অবশ্যই ভাবি যে সমাজ ও দেশকে দেবার মত আমার এবং কবিরের মতই, এমনকি আমাদের দুজনের চেয়েও আরো বেশী দেবার ছিল হয়তো তার। কিন্তু সে হয়তো পারেনি, আর সমাজ এবং দেশ হিসেবে আমরাও বঞ্চিত হয়েছি।

পরবর্তীতে কিছু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি যার মাধ্যমে এরকম সুযোগ-বঞ্চিত, অবহেলিত কিছু মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সামান্য হলেও প্রতিষ্ঠানিক ভাবে কাজ করছি। কিন্তু সেই আকবরকে এখনো মনে পড়ে, যাকে পরে আর খুঁজে পাইনি।

এরকম আরো অনেক আকবরের কথা আমরা অনেকেই জানি। আজ সুমি আর কৃষ্ণের কথা জেনে একদিকে যেমন খুবই ভালো লাগছে, তেমনি ভাবছি আমাদের সমাজে এমনি অনেক সুমি, কৃষ্ণ আর আকবরের কথা। কোন জীবন একটি খবরযোগ্য কাহিনী না হলে আমরা সচরাচর ভাবিই না। আর কাহিনী হলেও আমরা অনেক সময় সেই কাহিনীর সীমাতেই বাঁধা পড়ে যাই। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল কি? আমাদের প্রত্যয়, আমরা “একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি”। আমাদের দেশ-বাগানের প্রতিটি ফুল বাঁচানোই আমাদের জন্য যুদ্ধ হতে হবে, যাতে আমরা এমন একটি দেশ-বাগানে পরিণত হই যে বাগানে সুমি-কৃষ্ণ-আকবর নামের প্রতিটি মেধা-ফুলই যেন বাঁচে, বিকশিত হয় এবং তাদের অবদান সৌরভে আমরা সবাই গৌরবান্বিত হই। বিজয়ী হই। সবাই। একসাথে।

ডঃ মোহাম্মদ ওমর ফারুক: ইসলামী ফাইন্যান্স বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, সহযোগী অধ্যাপক,অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অফ বাহরাইন farooqm59@yahoo.com]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।