একটি দিন । ।
খুব সকালেই ঘুম ভাঙলো কিশোরের। এখনই ছুটতে হবে স্কুলে। আজ ক্লাস নেই তার এবং তার মতো আরও কিছু ছাত্রের। আজ যে বিশেষ দিন। সৌভাগ্যের দিন। কাছ থেকে কিংবদন্তিকে দেখার দিন। সুযোগটা এসেছে কাবস-স্কাউট করার সুবাদে।
দ্রুত তৈরি হচ্ছে কিশোর। স্কাউট ড্রেস, স্কাউট গীয়ার্স সব ঠিকঠাক মতো রেডি করে রেখেছেন মা। ইস্ত্রি করা খাকি হাফ প্যান্ট, সোল্ডার শার্ট, স্কার্ফ, হুইসেল, বেল্ট, নাইফ, রোপ, মোজা, জুতা সবই পরা হলো। শুধু বাঁধা হলো না জুতোর ফিতা। এই কাজটাতেই তার মায়ের উপর নির্ভরতা। মা যথারীতি কাজটা করে দিলেন, তারপর দে ছুট। আপাত গন্তব্য কলেজিয়েট স্কুল।
স্কুলের সামনে একটা বাস দাঁড়ানো। টিপে টিপে ভেঁপু বাজানো কালুরঘাটের সেই মুড়ির টিনের বাস। বাসের আশপাশে জনা ত্রিশেক কাবস-স্কাউট জটলা মতো করে আছে। যাদের অধিকাংশই সিক্স-সেভেনের ছাত্র। লিডার জুনায়েদ কেবল ক্লাস টেনের ছাত্র। আর আছেন স্কাউট কাম ড্রয়িং স্যার খ্যাতিমান মোখলেসুর রহমান। অনেক বিখ্যাত মানুষের প্রিয় শিক্ষক তিনি। নিয়মের ব্যত্যয় হলে শাস্তি অবধারিত। শাস্তির ধরণও অভিনব। দুইকান ধরে চিৎকার করে বলতে হতো,‘লজ্জা পেয়েছি, ক্ষমা চাই। ‘ শাস্তি ভোগ করেনি এমন ছাত্র মেলা ভার। স্যার বললেন,‘আজ রাষ্ট্রপতি আসবেন, আমরা তাকে রিসিভ করতে যাবো। তোমরা সবাই উঠে পড় বাসে। ’ সবাই বাসে উঠলো। সেøাগান ধরলো স্কাউট লিডার ‘এক নেতা, এক দেশ। ’ গলা ফাটিয়ে বাকিরা বলে উঠলো ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। স্লোগান মুখরিত বাস ছুটলো পতেঙ্গা এয়ারপোর্টের দিকে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে বাইরের মূল রাস্তায় এই শহরের বেশ কিছু স্কুলের স্কাউট আর কাবস জড়ো হলো। তারা সারি করে দাঁড়ালো নেতাকে অভ্যর্থনা জানাবে বলে। এখন অপেক্ষা তার আগমনের।
ভরা রোদের আকাশ। সেই আকাশে চোখ কিশোরের। হয়তো সেদিকে চেয়ে আছে আরও কেউ কেউ। অনেকটা সময় পেরিয়ে সেই আকাশে দেখা মিললো একটা প্লেনের। চক্কর দিয়ে পাখির মতো নেমে আসছে রানওয়েতে। টারমাক স্পর্শ করা আকাশযানের বিকট গর্জন জানান দিচ্ছে অপেক্ষার অবসানের।
নেতা আসছেন। সারিবাঁধা কিশোর দল সচকিত, সতর্ক। যাবতীয় প্রোটোকল শেষে একটি সাদা রঙের কার নেতাকে বহন করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। অপেক্ষায় থাকা কিশোররা প্রস্তুত নেতাকে অভিবাদন জানাতে। ধীর গতিতে গাড়িটা আসছে, ক্রমশ কাছে। আওয়াজ এলো ‘স্কাউট প্রস্তুত, এবার অভিবাদন জানাতে হবে। ’ অন্য সবার সাথে কিশোর দু’আঙ্গুলের সেই বিশেষ কাবস স্যালুট দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে নেতাকে দেখলো, কাছ থেকে। হবে হয়তো হাত-দুহাত দূরে। গাড়ির পেছনের সিটে বাম পাশে বসা ইতিহাসের মহানায়ক। গ্লাসটা নামানো, মুখটা জানালার কাছে, ডান হাতটা প্রায় বাইরে এনে হাত নেড়ে অভিবাদনের জবাব দিলেন। মুখভরা মমতা মাখানো হাসি। চোখজোড়ায় কাজল দীঘির গভীরতা। সেই মায়া, সেই গভীরতা যেন গোটা বাংলাদেশকে ছুঁয়ে গেছে। কিশোর জানে তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের কথা। জানে ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো আর ভারতের মহাত্মা গান্ধীর কথা। ইনিইতো তিনি। এই রাষ্ট্রের জনক, বাঙালির মুক্তির দিশারি। আমাদের গান্ধী - সুকার্নো আতাতুর্ক।
নেতার গাড়ি, সাথে বহর। ছুটছে শহরের দিকে। শহর থেকে হেলিকপ্টারে যাবেন বেতবুনিয়ায়। রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা আছে সেখানে। চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের পাশে কাপ্তাইয়ের কাছে কাউখালির একটা এলাকা বেতবুনিয়া। ১২৮ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশন। এই তথ্যপ্রযুক্তি সারা দুনিয়ার সাথে যোগাযোগের দুয়ার খুলে দেবে। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের যুগান্তকারী উদ্যোগ। বিশ্বের অন্য দেশের সাথে তথ্য আদান প্রদানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতের ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র ব্যবহার করতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মুজিব তাতে সায় দেননি। তার আগ্রহ নিজের দেশের একান্তই নিজস্ব ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। তিনি আজ সেই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে এসেছেন।
আরেকটি দিন । । ১৫ আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭৫
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেষবার যখন চট্টগ্রাম এসেছিলেন তার ঠিক দু’মাস পর। কলেজিয়েট স্কুলের মর্নিং শিফট শুরু হয় সকাল ৭টায়। সাড়ে ছ’টা থেকে ছাত্রদের আসা শুরু হয়। সেই কিশোর স্কুলে এসে শুনতে পেলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মেরে ফেলা হয়েছে। ‘অ্যাস্যাসিনেইশন’-যার অর্থ কিশোর জানে না। বিখ্যাত লোকদের খুন হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে যদিও আরো ঘটেছে। কিন্তু এই মৃত্যু কল্পনায়ও আনতে পারছে না। এই মাপের একজন মানুষ এমন নাই হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারে না কিশোর। যে লোকটা দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাকে মেরে ফেলা হলো। মানুষ কী পাশবিক হতে পারে। দুমাস আগের তাজা সেই স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে আজ।
ক্লাস আর হলো না, হবেও না। শোনা গেল স্কুল ছুটি। ছুটির ঘণ্টা বাজালো না দপ্তরী। মুখে মুখেই ছুটি। ছুটি হলে চলে যেতে হয় এটাই নিয়ম। কিন্তু আজ কেন যেন তার চলে যাওয়ার তাড়া নেই। আনমনা কিশোর কেমন যেন উদাসীন। নিয়ম ভাঙতে চায় সে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব সে জানে না।
স্টেশন কলোনি ফেলে ওভারব্রিজ পেরিয়ে চৈতন্য গলির পথ ধরে এনায়েত বাজারের বাসা। এটাই কিশোরের নিত্য ফেরার পথ। আজ সে পথে পা বাড়ালো না। আরেক সহপাঠীসহ আইস ফ্যাক্টরি রোডের বড় রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলো। সহপাঠী বন্ধুটি অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে। এটা কি করে সম্ভব? কেমন করে হলো, সেও মেনে নিতে পারছিলো না। কিন্তু সহপাঠীর বকবকানি তার মোটেও ভালো লাগছিলো না। নিউমার্কেট পার হয়ে রাইফেল ক্লাবের সামনে এসে সহপাঠী বন্ধুটি লালদীঘির দিকে তার বাসার পথ ধরলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো কিশোর। মন তার বড়ই খারাপ। একা থাকতেই ভালো লাগছে। বাসায় ফিরতে মন চাইছে না কিছুতেই। কী হবে বাসায় ফিরে?
ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে লেখা।
লেখক- রুশো মাহমুদ,সম্পাদক,সুপ্রভাত বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময় : ১০২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৬
আরএইচএস