২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এক যুগ পার হলো। বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
তৃতীয় বিশ্বে হত্যা-খুন-ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। মহাত্মা গান্ধীর খুন হওয়ার পর ভারতবর্ষ ‘স্বাধীন ভারতযাত্রা’ শুরু করেছে। তাকে হত্যা করেছে নথুরাম গডসে। কিন্তু গডসে শুধু একজন বিচ্ছিন্ন হত্যাকারীই নয়। গডসে ভারতের কট্টরপন্থি ও উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদের চিন্তা-চেতনায় আলোড়িত এক হত্যাকারী। এমন উগ্রবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত গডসের প্রেতাত্মারা ভারতবর্ষ থেকে এখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় বাংলাদেশও জাতির জনককে হারায় এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ১৫ আগস্টের সেই অসমাপ্ত অপকর্মটিই ২১ আগস্টে সমাপ্ত করতে চেয়েছিল খুনিচক্র।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার বিচার হবে। এমনটিই প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা দেখেছি বিচারকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার নানামুখি অপচেষ্টা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তখন ক্ষমতায়। তাদের ইশারা-নির্দেশে ‘জজমিয়া’ নাটকের মঞ্চায়নও হয়। কিন্তু সত্যকে কিছুদিন লুকিয়ে রাখা যায়। চিরদিন নয়। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির কাছে সে নাটকের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়।
বিচারকে যে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছে তা আসামিদের বয়ানেই স্পষ্ট। পরবতীকালে গ্রেফতারকৃত হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ অন্যরা অকপটে সেকথা স্বীকারও করছেন।
আওয়ামী লীগ নাকি নিজেরাই একাজ করিয়েছে-- এমন কথাও আমরা শুনেছি। জনসমর্থন-সহমর্মিতা বাড়াতেই নাকি আওয়ামী লীগ এ হামলা করিয়েছে। শেখ হাসিনার ভ্যানিটি ব্যাগেই নাকি বোমা ছিল। যুক্তি (কুযুক্তি, অযুক্তি) হিসেবে এও বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা কীভাবে বেঁচে গেলেন? এসব অপ-প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মূলত দেশের আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের রাজনীতির গায়ে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যে কলঙ্কের সূচনা ২১ আগস্টে এসে তাকে আরো বিস্তৃত করা হয়েছে।
একথা সত্য যে, এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নানাধরনের কাণ্ডকীর্তি হয়। কিন্তু তাই বলে নিজের গায়ে বোমা মেরে ক্ষমতায় যাওয়া! এসব আষাঢ়ে গল্প বিকৃত রাজনৈতিক প্রতিহিংসারই নামান্তর।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি দিয়েও জাতিকে একই কাহিনী শোনানো হয়েছিল। ৪০ দিনের মাথায় ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনেও বলা হয়, ওই হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। কিন্তু তারা কারা তা স্পষ্ট করা হয়নি। ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে মাত্র। দেশীয় কুশীলবদের দৃশ্যপট থেকে আড়াল করে বিদেশি জুজুকে আসামি করা হয়েছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। পৃথিবীর জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও এরকম হত্যাকাণ্ড আর দ্বিতীয়টি নেই। ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ইরাকের রাজা ফয়সালকে ক্ষমতাচ্যুত করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদাল করিম কাসেম। সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি হত্যা করেন রাজা, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মা ও খালাকে।
গান্ধীর কথাতো আগেই বললাম। নেপালে দ্বীপেন্দ্র হত্যা করেন তার পিতা রাজা বীরেন্দ্রকে। সাথে নিহত হন রানী ঐশ্বরিয়া, প্রিন্স নিরাজন, প্রিন্সেস শ্রুতি ও রাজপরিবারের আরো পাঁচজন। এরকম হত্যাকাণ্ড আরো হয়েছে। কিন্তু কোনো ঘটনাই ১৫ আগস্টের ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। ১৫ আগস্টে শুধু ঘটনাক্রমে বেঁচে যান একটি রাজনৈতিক পরিবারের দুইট মেয়ে---দুই বোন শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা।
২১ আগস্ট সেই ১৫ আগস্টেরই অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরই ধারাবাহিকতা এবং পঁচাত্তরের পর জাতির জীবনে সবচেয়ে বর্বরোচিত ঘটনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার এমন পাশবিক প্রচেষ্টা সমকালীল বিশ্ব রাজনীতিতে বিরল।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা নয়, আইনের শাসন কায়েম করা’’।
২১ আগস্টের হামলার বিচারের মাধ্যমে দেশে হত্যা-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৬
জেএম/