১৯৮১ সালের ৬ অক্টোবর আমরা বিয়ে করেছিলাম। সেই হিসাবে এ দিনটি ছিলো আমাদের বিয়েবার্ষিকী।
কিন্তু তুমি ছিলে ঠিক অন্যরকম, আমার বিপরীত। বিয়েবার্ষিকী উদযাপন করতেই হবে। ঘটা করে করা হয়নি কখনই, কিন্তু তুমি প্রতিটি বিবাহবার্ষিকী উদযাপন করেছ একান্ত নিজের মতো করে। এ দিনটিকে ভুলতে থাকতে তোমাকে আমি দেখিনি কখনো। আমার হয়তো একদমই কিছু মনে নেই, কিন্তু তুমি ঠিকই মনে করে আমার জন্য ছোট উপহার আর ফুল দিতে ভুল করোনি।
একদিনের কথা বিশেষভাবে মনে আছে। আমি বাইরে ছিলাম, হঠাৎ তোমার ফোন বেজে উঠলো। তুমি জিজ্ঞেস করলে, মিতু কি খাবে? বিরিয়ানি, না নান-চিকেন? আমি তো রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলাম, কেন বিরিয়ানি খাব? তোমরা বুঝি টাকা খরচ না করলে চলে না? তখন তুমি আমাকে শান্ত করার জন্য বললে, আজ আমাদের বিয়েবার্ষিকী। শুনে আমি শান্ত হলাম।
আমাদের বিবাহকাল ছিল ৩৪ বছর কয়েক মাস। ৩৪ বছরকে যদি অর্ধেক করি তাহলে দাঁড়ায় ১৭ বছর। কারণ রাতটা বাসায় থাকতে, দিনে থাকতে অফিসে। আর তোমার অফিস তো কখনো ৮ ঘণ্টার হিসাবে বাঁধা ছিলো না; ছিলো না কোনো ছুটির দিন। এবার ১৭ কে যদি অর্ধেক করি তাহলে দাঁড়ায় সাড়ে ৮ বছর। তুমি হয়তো আমার সঙ্গে সাড়ে ৮ বছর ছিলে। কারণ এর মধ্যে তোমার ছিলো ফিল্ড ওয়ার্ক, ছিলো বিদেশে যাওয়া। সব মিলিয়ে সাড়ে ৮ বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম। এটা কি খুব বেশি সময়? কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলে? আরও না হয় কিছুকাল থাকতে আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে। এতো কি তাড়াহুড়োর দরকার ছিলো বলো?
আজ সবাইকে খুব জানাতে ইচ্ছা করছে কীভাবে তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলাম আমি। তুমি সুদর্শন ছিলে, স্মার্ট ছিলে তা বলছি না। তোমার বাইরের সৌন্দর্য তোমার প্রতি আকর্ষণের একটা বড় কারণ ছিলো বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিলো তোমার ভেতরকার সৌন্দর্য। প্রথমে মোহিত হয়েছিলাম তোমার গলার আওয়াজ শুনে, তারপর তোমার কথা বলার আর্ট দেখে। সর্বোপরি তুমি ছিলে সংস্কৃতিমনা। তুমি কবিতা আবৃত্তি করতে, নাটক করতে, ভলিবল খেলতে। তোমার প্রতিভা ছিলো বিচিত্র, আন-প্যারালাল্ড।
এসব কিছুই ছিলো তোমার প্রতি আমার অনুরক্ত হওয়ার মূল কারণ। আজ এ বয়সে এসে খুব মনে পড়ছে অতটুকু বয়সে আমি এসব বুঝেছিলাম কি করে?
আরও মজার কিছু বিষয় ছিলো আমাদের। ভালো লাগার অভিব্যক্তিও ছিলো অন্য সবার চেয়ে আলাদা। তুমি কবিতা লিখতে, কবিতা লিখেই আমাকে পড়তে দিতে। আমি পড়েই কি করে বুঝতাম যে তুমি কবিতাটি আমাকে নিবেদন করেছো। তাই বলতেই হয় একটু বোধহয় বেশিই পাকা ছিলাম। এবং কবিতাই আমাদের সম্পর্ক তৈরিতে মূল ভূমিকা নিয়েছিল।
তার মধ্যে দু’টি কবিতার কথা না উল্লেখ করলেই নয়। একটি হচ্ছে ’মিতালীর অন্বেষায়। ’ অন্যটি ’কাঁচ দেয়াল। ’ মিতালীর অন্বেষায় কবিতার দুটি লাইন তুলে না ধরে পারছি না।
’কি এক দুর্বোধ্য সেতুবন্ধে
বেঁধেছ আমায়!
বুকেও টানো না উষ্ণ আলিঙ্গনে,
সরিয়েও দাওনা দূরে
ঘৃণাভরে। ’
’কাঁচ দেয়াল’ এও তাই।
’এ পাশে আমি
ও পাশে তুমি
মাঝখানে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল
এ পাশ থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
তোমার পূর্ণাবয়ব নির্বাক দৃষ্টি,
বসন্ত রঙ্গিন কপোল উদ্ধত যৌবন সব--সব।
নিশ্চিত করে বলতে পারি
তুমিও দেখছো আমাকে
অথচ:
মাঝখানে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল। ’
তাই বলছি তোমার কবিতা আমাকে নিশ্চিত করে বুঝতে শিখিয়েছে আমার প্রতি তোমার অনুরাগ। তারপর কোনো দুর্বল মুহূর্তে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, আমরা থাকবো একসঙ্গে। তাই সব ঝড়-ঝাঁপটা আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম।
এখানে বলে নেওয়া ভালো, আমরা ছিলাম দু’জন দুই সম্প্রদায়ের। আমাদের বিয়ে হয়েছিল দু’বার। একবার আমার স্বামীর ধর্মমতে, দ্বিতীয়বার আমার ধর্মমতে। আমাদের তাতে কোনো অসুবিধে ছিলো না। আমরা দু’জন এক পর্যায়ে হেসে বলেছিলাম, আরও যদি কোনো মত থাকে তাহলে সেটাও আপনারা ব্যবহার করতে পারেন।
আজ এ বিষয়ে আমার সবার কাছে একটা প্রশ্ন: বিয়ে কি মানুষ ধর্মকে করে? না একজন নারী বিয়ে করে একজন পুরুষকে এবং উল্টো দিকে একজন পুরুষ বিয়ে করে একজন নারীকে। ধর্ম তো শুধুই একটা বিশ্বাস। যে বিশ্বাস আমরা আমাদের মনের গভীরে ধারণ করি।
মনের গভীরে যে বিশ্বাস আমি লালন করছি জন্মাবার পর থেকে, তা কি উপড়ে ফেলা যায়? সেতো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তিগত ভালো লাগার অনুভূতি, ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে উৎসর্গ করা।
যাক এখন আসল কথায় আসি। প্রসঙ্গ ছিলো আমাদের বিবাহবার্ষিকী। তুমি চলে যাওয়ার পর এই প্রথম বিয়েবার্ষিকীকে স্মরণ করছি এভাবে। যে কাজটা তুমি করতে এতোদিন। আর এবার বেদনার সঙ্গে আমি স্মরণ করলাম এভাবে। তোমরাই কবিতার দু’টি লাইন দিয়ে তোমাকেই প্রণতি জানালাম।
এ পাশে আমি
ও পাশে তুমি
মাঝখানে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল।
আসলেই তাই, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ছুঁতে পারছি না। এটাই আমার যন্ত্রণা। অনেক অনেক ভালো থেকো।
তোমার মিতু।
[আমার স্বামী অচিন্ত্য দাশ গুপ্ত, ডেভেলপমেন্ট সাপোর্ট লিংক-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, ৪ এপ্রিল, ২০১৬-তে প্রয়াত হন। ]
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৬
এএ