সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (MDG) অর্জনের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে আগামী ২০১৫ সালে পৃথিবীর দারিদ্র্যের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। এর জন্য বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন : থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ, নেপাল, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, কিউবা, সাইপ্রাস, মরিশাস, সেন্ট নেভিস অ্যান্ড কীটসসহ অন্যান্য ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে পর্যটন যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। অথচ, বাংলাদেশের PRSP-তে পর্যটন উন্নয়ন এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা গ্রামীণ বেকারত্ব দূরীকরণের যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি।
বর্তমান বিশ্বের দ্রুত আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অনিয়ন্ত্রিত বিশ্বায়নের কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সর্বত্র পরিলক্ষিত। বাংলাদেশেও এর প্রভাব যথার্থই টের পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি কৃষি ও গ্রামীণ শিল্প বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা করা ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণের চেয়েও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের আর্থিক সচ্ছলতাসহ এদের স্থায়ী উপার্জনের পথ সুগম হয়। এর জন্য ছোট ছোট পর্যটন উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে সরকারিভাবে ঋণও দেওয়া যেতে পারে।
গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের জন্য আমাদের গ্রামাঞ্চলে অনেক ঐতিহ্যগত দিক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা, কৃষিজমির চিরায়ত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, চিরায়ত লোকসঙ্গীত, দেশীয় খাবার প্রস্তুতি যেমন চিঁড়া, মুড়ি, খৈ, খেজুরের পায়েস, মাডা ইত্যাদি। এগুলোই পর্যটকরা দেখতে চান, উপভোগ করতে চান। এসব পণ্য প্রসারের লক্ষ্যে ও তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বর্তমানে অনেক প্রাইভেট ট্যুর অপারেটর গ্রামীণ জীবনযাপন (Traditional Life Style) পর্যটকদের দেখানোর জন্য গ্রামে নিয়ে যায়। এভাবে গ্রামীণ জনগণের তেমন উপকার হয় না, গ্রামীণ জনগণের কাছে পর্যটন বেনিফিট পৌঁছানো যায় না। এসব কাজের জন্য গ্রামীণ মানুষেরই সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। একজন গ্রামীণ নারী যখন খৈ বা মুড়ি তৈরি করেন, তার দৃশ্য কিংবা একজন গ্রামীণ কৃষকের ধান কাটার দৃশ্য, খেজুর গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামানোর দৃশ্য পর্যটকদের যারা দেখিয়ে আয় করেন, তাদের উচিত ওই আয়ের একটা অংশ ওই নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের, যারা পর্যটন কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করল, হাতে দেওয়া। এতে করে তাদের আয় বাড়বে এবং বাঁচার তাগিদে অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মের পাশাপাশি পর্যটন কর্মকা- চালাবে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের জন্য একে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায় : ফার্মিং ট্যুরিজম, ইকো-ট্যুরিজম, গ্রিন ট্যুরিজম ইত্যাদি। ফার্মিং ট্যুরিজমের মধ্যে গ্রামবাংলার স্বকীয় কৃষি খামার ও জমির চাষাবাদ পদ্ধতি, ফসল কাটার দৃশ্য, সেচ প্রণালী, ফসল তোলা, গ্রামীণ নারীদের ধান শুকানো, ধান উড়ানো এবং ধান ভানার দৃশ্যই হচ্ছে এর অন্যতম আকর্ষণ। ইকো-ট্যুরিজম হতে পারে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি, নদী-নালা, খালবিল এবং দেশীয় মাছ, পশু-পাখিসহ নানা প্রজাতির জৈববৈচিত্র্য। গ্রামীণ ট্যুরিজমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গ্রিন ট্যুরিজম। অনেক বিদেশী বাংলাদেশের অবারিত সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হন। গ্রিন ট্যুরিজমের সব উপাদানই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যমান। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীত সব ঋতুতেই বাংলাদেশ সবুজে আচ্ছাদিত থাকে। সবুজের এ প্রাণচাঞ্চল্য অনেক বরফাচ্ছন্ন দেশের ট্যুরিস্টকে আন্দোলিত করে। অনেক স্ক্যান্ডিনেবিয়ান দেশের মানুষ বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল গ্রামীণ জনপদকে ভালোবাসেন, দেখতে আসেন।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রাথমিকভাবে ঢাকার আশপাশের জেলাসহ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হালুয়াঘাট, সিলেট এবং সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন করা যেতে পারে। এসব জেলায় এমনিতেই যথেষ্ট পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশের সম্ভাবনা আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে বিদ্যমান প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই কোনো ভারী শিল্পের উন্নয়ন করা যাবে না। এর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং স্থানীয় জনগণের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নই একমাত্র পথ। পর্যটনশিল্প এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান, আর্থিক প্রবাহ সৃষ্টি করবে। তবে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ-খাইয়ে এখানকার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এসব জেলার স্থানীয় সম্প্রদায় তথা যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে, তাদের দূরে রেখে পর্যটন উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখানে প্রতিটি জাতিসত্তারই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও আকর্ষণ রয়েছে। তাই এখানে পর্যটন উন্নয়ন করতে হলে স্থানীয় যে কটি জাতিসত্তা রয়েছে তাঁদের পর্যটন সম্পদের মালিকানা প্রদান ও মালিকানা বোধ (Sense of Ownership) জাগ্রত করতে হবে। এরাই আর্থিক আয় ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের তাগিদে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন পণ্যকে রক্ষা করবেন।
বাংলাদেশে গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের সাথে পরিবেশ-পরিকল্পনা অবশ্যই পাশাপাশি থাকবে। পরিবেশের ক্ষতি করে যেমন গ্রামীণ পর্যটন হবে না, আবার শুধু পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিলেও পর্যটনের উন্নয়ন হবে না। বিষয়টি পরিপূরক। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন করতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সরকারের বিনা সুদে ঋণ কিংবা সহজ শর্তে ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন গ্রামের একজন লোক পিঠা, পায়েস বা দই তৈরি করে বাজারে কিংবা পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন। তার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এবং এসব পণ্যকে স্বাস্থ্যসম্মত ও আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সহজ শর্তে বা বিনা সুদে ঋণ তাকে নিশ্চয়ই আরো গতিশীল এবং সত্যিকারের টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করবে।
গ্রামীণ পর্যটনের উন্নয়ন করা হলে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং অনেক ধরনের ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা যেমন : চিঁড়া-মুড়ি-খই-দই, পিঠা-পায়েস-মোয়া, হস্তশিল্প (বাঁশ, বেত, হোগলা) প্রস্তুত ও বিপণনকারী এরকম অনেক উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবে। এদের টিকিয়ে রাখার জন্য সহজ শর্তে সরকারি ঋণের প্রয়োজন।
আমাদের এখানে এরকম ধারণা আছে, পর্যটন উন্নয়ন হলে গ্রামীণ পরিবেশ ও সংস্কৃতি বিনষ্ট হবে। আসলে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য পরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত পর্যটন উন্নয়নের প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটক সবার দায়িত্ব পর্যটন উন্নয়নের পাশাপাশি পর্যটন পণ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। একে Responsible Tourism বলা হয়। ইকো-ট্যুরিজম, গ্রিন ট্যুরিজম, নেচার ট্যুরিজম এসব কিছুই Responsible Tourism -এর অংশ।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। এখন সরকার গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের দিকে যথাযথ নজর দিলে সত্যিকারভাবেই Millennium Development Goal (MDG) অর্জন করতে পারে।
লেখক : ভ্রমণ লেখক ও পর্যটন বিশেজ্ঞ। ই-মেইল : xs4allzhb@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ১০২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১১