ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কোহিনুর মিয়ার প্রেতাত্মারা!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১১
কোহিনুর মিয়ার প্রেতাত্মারা!

কোহিনুর মিয়ার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। খুনের মামলার ওয়ারেন্ট! বিএনপি-জামায়াত জমানার সেই দলবাজ দাপুটে পুলিশ অফিসার কোহিনুর মিয়া! ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন! এখন কোথায় কোহিনুর মিয়া? পলাতক।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হুলিয়ার প্রতিবাদে কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলা(!)-হুলিয়ার জন্য তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। কোহিনুর মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা-হুলিয়ার প্রতিবাদে কি একটি বিবৃতি দিয়েছে বিএনপি? না কোনদিন কোনও খোঁজ-খবর নিয়েছে? এসব দেখেশুনে কোন হুঁশ-জ্ঞান কি ‘এই আমলের কোহিনুর মিয়াদের’ মধ্যে সৃষ্টি হয়?
 
কোহিনুর মিয়া সিনড্রোম অবশ্য একটি রোগের নাম! অপ সামাজিক-রাজনৈতিক রোগ। আমাদের দুই নম্বরি রাজনীতি এর পৃষ্ঠপোষক। পাকিস্তান আমলের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশের শুরু থেকে এসব চলে আসছে এবং এখনও চলছে। কারণ মেধাগত যোগ্যতায় না, দলবাজির জন্য এসব দুষ্টগ্রহ কোহিনুর মিয়ারা চাকরি-প্রমোশন পায় । অথবা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢোকে। সারদা পুলিশ একাডেমির চৌকাঠ ডিঙ্গায় ঘুষে। এরপর নিজে ঘুষ খায়, স্যার-লিডারের জন্যে খায়। ঘুষ বিনে বাঁচিতে পারে না। এরপর ঘুষ-চাকরি ঠিক রাখতে সো-কল্ড স্যার-লিডার যা বলে তাই করে। অথবা গায়ে পড়ে সবকিছুতে একটু বেশি করে। হয়ে যায়, ‘ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ!’

তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের রাজপথে পিটিয়ে তক্তা বানানোর পারফরমেন্সে এই কোহিনুর মিয়া যখন আলোচনায় আসে তখন সে পুলিশের একজন এসি মাত্র। এরপর খোঁজ-খবরে ছাত্রদলের ক্যাডার হিসাবে প্রকাশ পায় তার জীবনবৃত্তান্ত! কিন্তু সে যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের রাস্তায় ফেলে আচ্ছামতো পিটিয়েছে, হাড়গোড় ভেঙ্গে দিয়েছে, এই পারফরমেন্সের জন্য পুলিশে তার তরতর প্রমোশন হয়েছে! একটি দল, সরকার, রাষ্ট্র কতটা ব্রুটাল কিসিমের হলে এমনটি সম্ভব?

দলবাজির পুরস্কার হিসাবে নিজস্ব পুলিশ চরিত্র কোহিনুর মিয়াকে আমেরিকায় পেশাগত প্রশিক্ষণের জন্যেও মনোনীত করে বিএনপি সরকার। যাতে সে আমেরিকায় প্রশিক্ষণ-ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভালো পেটাতে পারে! কিন্তু দুনিয়া জুড়ে আমেরিকানদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র না হলেও তারা তাকে ভিসা দেয়নি। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তার নানা কাণ্ডকীর্তির রিপোর্ট-ছবি, বিদেশের মিডিয়া-মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টের ফাইল দেখিয়ে বলে, এধরনের একজন লোক আমেরিকায় প্রবেশের ভিসা পেতে পারেন না।
 
মূলত কোহিনুর মিয়ার ব্রুটালিটির রিপোর্ট-রেকর্ড ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে জমা আছে দেখে তার ব্যাপারে সতর্ক হয় বিএনপি। এরপর তারা তাকে যা যখন দিয়েছে তা গোপনে দিয়েছে। খুনের মামলার হুলিয়া সূত্রে জানা গেল ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার হিসাবে তার শেষ পোষ্টিং ছিল।
 
কোহিনুর মিয়ার এই আমলের প্রেতাত্মাগুলোর কি অবস্থা? বিরোধীদলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর যে দুই দলবাজ পুলিশ অফিসার হাত তুলেছে, তাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় কোহিনুর মিয়ার? ঘটনার পর পুলিশের নিন্দা না করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, পুলিশকে যেন উত্তেজিত করার চেষ্টা করা না হয়। এর মানে দাঁড়ায় জয়নুল আবদিন ফারুক পুলিশকে উত্তেজিত করেছেন, তাই ‘উত্তেজিত’ পুলিশ তাকে মেরেছে, এটা ঠিক আছে! তাই নয় কি? এই যদি হয় দলবাজ পুলিশ অফিসারের রক্ষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, তাহলে পুলিশের ব্রুটালিটি কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, সহজেই তা ধারণা করা যায়। তাহলে বিএনপি আমলে পুলিশ যখন রাজপথে মতিয়া চৌধুরীর গায়ে হাত তুলেছিল, তখন কেন আমরা ঘটনার নিন্দা করেছিলাম? সাহারা খাতুন কি সেদিনের নিন্দা-প্রতিবাদের জন্যে আজ পুলিশের কাছে লজ্জিত-ক্ষমাপ্রার্থী?

আমাদের দলগুলো এমন ক্ষমতার স্বার্থে ভোটার জনগণকে রাস্তায় সাপের মতো পেটায়। এসব করলে পুলিশের প্রশংসা-প্রমোশন পোস্টিং বাড়ে বলে তারা যা খুশি করে। প্রমোশনের জন্যে করে, ঘুষের জন্যে করে। জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাকারীদের আড়াল করতে প্রথমে অসুস্থ সাজিয়ে শুইয়ে রাখা হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে। এরপর চিকিৎসার নামে পাঠিয়ে দেয়া হলো বিদেশে! এসব আস্কারার ফলাফল কি? বাবরের পরিণতি, সাবেক তিনজন আইজিপিকে জেলের মধ্যে দেখেও কি কারো মধ্যে কোন ভয়ডর তৈরি হয় না?
 
অতএব এসব অনৈতিক আস্কারা-প্রশ্রয়ে ভেঙ্গে পড়ছে পুলিশের পেশাদারিত্ব। এখানে দলবাজরা পুলিশের পোশাক পরে সারাক্ষণ খালি খাই খাই করে। কোথাও ভুল করলে ভুল লুকোতে আরও জঘন্য সব কাজ করে।

লিমনের ঘটনা কি র‌্যাব-পুলিশের তেমন একটা কাজ না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদের কি পুলিশের তেমন বেপরোযা দুর্বৃত্তপনার শিকার না। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের পুলিশ যদি একটা ছেলেকে মেরে ফেলার জন্য গণপিটুনির ব্যবস্থা করাতে পারে, এমন নিষ্ঠুর শিক্ষা পুলিশকে দেশের কোন প্রতিষ্ঠানে শেখানো হয়, কেন শেখানো হয় এর জবাব ট্যাক্সপেয়ার মানুষজনের কাছে কে দেবে?
 
একের পর এক ব্রুটালিটি শুধু ঘটছে, পুলিশ মিথ্যা বলছে, অথবা আইজিপি-মন্ত্রী মিথ্যা বলছেন পুলিশের পক্ষে, সবমিলিয়ে সবাই মিলে কি দেশটারে একদল ব্রুটাল-মিথ্যাবাদীদের স্বর্গরাজ্য বানানোর পণ করেছেন? এত ব্রুটালিটি সত্ত্বেও কেউ একজন কোথাও কিছুর দায়িত্ব নিচ্ছেন না। একেকজন এত বেহায়া বেশরম যে এতসব যে অকল্পনীয় ঘটনা ঘটছে, এর দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করে চলে যেতেও ইচ্ছা করে না? চামড়ার পুরুত্ব কি গন্ডারকেও ছাড়িয়ে গেছে? কোহিনুর মিয়ার প্রেতাত্মারা সাবধান হবেন কবে। এখনও এমন ব্রুটালদের বউ-ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা যার যার বাসাবাড়িতে থাকতে পারছেন। এমন নিরাপদ তারা যে আগামীতে থাকতে পারবেন, সে গ্যারান্টি কে দিয়েছে? বিএনপিতো একদার প্রিয় কোহিনুর মিয়ার জন্য আজ একটা বিবৃতি দিতেও নারাজ! অতএব সাধু সাবধান!

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১২২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।