ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘জলবায়ু’ও হতে পারে রাজনৈতিক সংলাপের এজেন্ডা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৬
‘জলবায়ু’ও হতে পারে রাজনৈতিক সংলাপের এজেন্ডা

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। একক কোনো রাষ্ট্র বা ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। একক কোনো রাষ্ট্র বা ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

সে কারণেই জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ফোরামে বা সম্মেলনে এ সমস্যার সমাধানে বৈশ্বিক করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা-দেন দরবার হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো। তাই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের এজেন্ডাগুলোই প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী, তাই কার্বণ নি:সরণ বা তহবিল গঠনের টার্গেট পূরণে তাদের ভূমিকার ওপর জোর দেওয়া হয়।  

জলবায়ু বিষয়টি বৈশ্বিক হলেও এর আঞ্চলিক ও আন্ত:রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার প্রেক্ষাপটটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মরক্কোর মারাক্কেশে অনুষ্ঠিত এবারের জাতিসংঘের ২২তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনেও সে কথাটি উঠে এসেছে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার ওপর আবারও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে মারাক্কেশ সম্মেলনে।  

এক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে চীনের সাম্প্রতিক ইতিবাচক ভূমিকার জন্যই প্যারিস চুক্তিটি আলোর মুখ দেখতে পেরেছে। আমেরিকার ভূমিকাও একইভাবে ইতিবাচক।

মারাক্কেশ ঘোষণায় একটি শক্তিশালী জলবায়ু তহবিল গঠন ও ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ঘোষণায় তহবিল গঠনে রাষ্ট্রগুলোকে ২০২০ সালের মধ্যে ১ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণে যদিও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে কার্বণ নি:সরণ-হার রোধ এবারের সম্মেলনে বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় ‘তহবিল’ গঠন অগ্রাধিকার পায়নি।

প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নকে সামনে রেখেই এবারের এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাপমাত্রা হ্রাসের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে (এ শতাব্দীর মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি নয়) তার বাস্তবায়ন না হলে তহবিল গঠন দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। এ মুহুর্তে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধেই এগিয়ে আসতে হবে। তবে প্রতিকারমূলক কার্যক্রম হ্রাস করা যাবে না।  

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার শর্ত পূরণে প্যারিস চুক্তিটি জরুরি ছিল। চীন ও আমেরিকার এগিয়ে আসার মধ্য দিয়ে সে শর্ত পূরণ হলো।

বাংলাদেশও স্বত:প্রণোদিতভাবে প্যারিস সম্মেলনেই বলেছে, ‘নিজস্ব অর্থায়নে ৫ শতাংশ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা পেলে আরও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কার্বণ নি:সরণ কমবে’।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিলেই এটি সম্ভব। আমাদের কার্বণ নি:সরণের প্রধান উৎস হচ্ছে জ্বালানি, পরিবহন ও শিল্পখাত। যথাযথ জ্বালানি তথা পরিবহন ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।     

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থায়নেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতিরোধ, প্রতিকার ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন জরুরি। আমরা এ আন্তর্জাতিক তহবিল থেকে সরাসরি অর্থ প্রাপ্তির দাবি করেছি। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রথম সারির দেশ। আমরা নিজেদের সম্পদ থেকে ৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সাফল্য আছে। সিডর, আইলা, রোয়ানুর মতো এ রকম আরও নজির আছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আমাদের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনই সেখানে মূল চ্যালেঞ্জ। তার সঙ্গে যদি জলবায়ু বিষয়ক সহগামী/অনুগামী বিষয়গুলো যুক্ত হলে দারিদ্র্যসহ আরো নানা দুর্যোগ আমাদের উন্নয়ন যাত্রাকে শ্লথ করে দেবে। তাই জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।

জলবায়ু সমস্যার সমাধান করতে হলে রাজনৈতিক ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সেটা রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। আমাদের মতো রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ ও সংকটময় পরিবেশে জলবায়ুর মতো ইস্যুটি গুরুত্ব পায় না। শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তহবিল সংগ্রহের ওপরই জোর দেওয়া হয়। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখা যায় না।

মারাক্কেশে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই প্যারিস চুক্তির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। সে আশঙ্কা দূর হয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে চীন ও আমেরিকার সম্মতির মধ্য দিয়ে  আন্তর্জাতিক পরিসরে এক ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১১০টি দেশ (যাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্পোন্নত)  প্যারিস চু্ক্তিতে দ্রুততার সঙ্গে স্বাক্ষর করে। পরে সর্বমোট ১৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করে। এটিই বড় রাজনৈতিক ঐক্য। আর মারাক্কেশ সম্মেলনের এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।

আমাদের রাজনৈতিক বিভাজনের মূল কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। আবার রাজনৈতিক বিভাজন দূর করতেও আমরা একমাত্র রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলো নিয়েই আলোচনা করি। ফলে রাজনৈতিক ঐক্যেতো পৌঁছাতে পারিই না, বরং ঐক্য ও সম্ভাবনার অন্য পথগুলোও রুদ্ধ হয়ে যায়। এটি উন্নয়ন, রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ।

কূটনৈতিক বিরোধ থাকলেও বিবদমান দু’টি দেশ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় না। আমরা দেখি, কার্গিলে ভারতের জওয়ান আর পাকিস্তানের ফৌজ গোলাগুলি করে আর লাহোরে দুই প্রধানমন্ত্রী গলাগলি করেন, শান্তির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। এটাই কূটনীতির সৌন্দর্য। রাজনীতিরও সৌন্দর্য আছে। বিভাজনের বিষয়গুলো পাশে রেখে ঐক্য গঠনের সম্ভাবনাময় এজেন্ডাগুলো নিয়ে আলোচনা করে সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোকে আরো প্রসারিত করা যায়।

এ মুহূর্তে জলবায়ুই আমাদের জাতীয় টপ এজেন্ডা। আলোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে এটি নিয়েও। পর্দার অন্তরালে অথবা এপারেও। হয়তো এজেন্ডা হিসেবে সামনে আসবে ‘নির্বাচন কমিশন’ ‘রাজনীতি’ এবং অন্য বিষয়গুলোও। ‘জলবায়ু সংকট’ সম্ভাবনাময় রাজনীতির এজেন্ডা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং একইভাবে আগামীর জলবায়ু সংকট মোকাবেলার জন্যও এ রাজনৈতিক ঐক্য লাগবেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।