তখনো চালু হয়নি তিনবিঘা করিডোর! পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সারা বাংলাদেশ! মানুষের এক বয়সে অনেক কিছু হয়ে যেতে ইচ্ছে করে! এই মানুষটার তখন ইবনে বতুতা হবার স্বপ্ন। শায়েস্তা খাঁ’র আমলে আরব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা এসেছিলেন এ বঙ্গে।
২৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার জনগণ বাংলাদেশের মানুষ হয়েও স্বদেশে যাতায়াতের অধিকার বঞ্চিত। মাঝের বাধা তিনবিঘা নামের একটি ভারতীয় ভূখন্ড! ওই তিনবিঘার বুক চিরে আবার চলে গেছে ভারতীয় পিচ ঢালা পথ। যেটির ওপর দিয়ে সেদেশের গাড়িঘোড়া চলে। অতএব জীবনের নানা প্রয়োজনে ভারতীয় তিনবিঘা ভূখণ্ড মাড়িয়ে দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার মানুষজন একরকম চুরি করে জান হাতে নিয়ে নিজের দেশে আসেন! অথচ ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুসারে তিনবিঘা করিডোরের বিনিময়ে ভারতের হাতে বেরুবাড়ি তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। বেরুবাড়ির বিনিময়ে তিনবিঘা দেবার কথা থাকলেও ভারত তার কথা রাখেনি!
অতএব তেমন এক অস্বস্তিকর অবস্থার কারণে দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার মানুষজন পাটগ্রামের হাটের দিন ভোরে ফজরের নামাজেরও আগে অতিক্রম করে আসেন তিনবিঘা! সারাদিন পাটগ্রামের দরকারি নানা কাজ, বাজার-সদাই শেষে বিকেলের মধ্যে চলে আসেন সীমান্তের কাছে।
তিনবিঘার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখন্ডের গ্রামের মধ্যে বিডিআরের (আজকের বিজিবি) একটি ফাঁড়ি। সেখানে এসে জড়ো হন বাংলাদেশি হাঁটুরে লোকজন। এরপর মাগরিবের নামাজ পরে সবাই এক সঙ্গে তিনবিঘা করিডোর পেরিয়ে যান দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতায় নিজেদের বাড়ি!
সবকিছু শুনে তাদের সঙ্গে দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতা যেতে চাইলে লুঙ্গি-ফতুয়া পরিয়ে দেয়া হয় হাঁটুরের সাজ! কারণ সবার আগে বিডিআরের চোখ ফাঁকি দেওয়া দরকার। তাদের ফাঁড়ি হয়ে যাওয়া-আসার কারণে দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার প্রায় সব মানুষকে তারা চেনে। অপরিচিত আগন্তুক তা পরিব্রাজক হোক যে কেউই হোক তারা আটকে দিতে পারে।
কিন্তু যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হলো। অর্থাৎ হাঁটুরের বেশ নিয়েও ফাঁড়ির বিডিআর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়নি। বলা হয় ওখানে গিয়ে আপনি আবার কোন বিপদে না পড়েন! তাই এভাবে সেখানে আমরা আপনাকে যেতে দিতে পারি না।
কষ্ট হয় খুব। দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতা আমার দেশের অংশ। আমার দেশের বিডিআর কেন সেখানে আমাকে যেতে দেবে না? কিন্তু আমার আকুতি তাদের গলাতে পারে না। মাগরিবের নামাজের পর চোখের সামনে দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার হাঁটুরেরা তিনবিঘা ক্রস করে চলে যান । বিদেশি ভূ-খণ্ড সন্তর্পনে ত্বরিৎ পেরিয়ে গোটা দলটি মিলিয়ে যায় স্বদেশের অন্ধকারে!
তখনও ব্যর্থতার চাপাকান্নায় কাঁদছি। রাগে কাঁপছে শরীর! একটু স্বাভাবিক হবার পর ফাঁড়ির ইনচার্জ বললেন এই রাতের বেলা এখন আপনিতো আর একা পাটগ্রাম হেঁটে যেতে পারবেন না। বা তা নিরাপদও না। আপনার এ গ্রামে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করছি। সকালে উঠে পাটগ্রাম চলে যাবেন।
এক জওয়ানকে দিয়ে স্থানীয় একজন সম্পন্ন গৃহস্থকে ডেকে আনা হয় ক্যাম্পে। ইনচার্জ তার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ইনি আমার মেহমান। আজ আপনার বাড়ি থাকবেন-খাবেন। সকালবলা চলে যাবেন। অতপর সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি গৃহস্থের বাড়ি। খাওয়াদাওয়া শেষে কুপি নিভিয়ে নেতিয়ে পড়তে হয় শয্যায়। এরপর ডাইরেক্ট ঘুমের রাজ্যে।
আঠার মাসের পরিব্রাজক জীবনে সারাদেশের এমন বহু মানুষের বাড়িতে রেডিমেড মেহমান হবার অভিজ্ঞতা ঢের রয়েছে। সে সূত্রে দাবি করে যেটি বলা হয় তা হলো, এই পরিব্রাজক মানুষটা সেই মানুষ যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের বাড়িতে ভাত-খেয়েছে! বক্তৃতা দিয়েছে দেশের যেকোন ছাত্রনেতার চেয়ে বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বলাবাহুল্য এসব চ্যালেঞ্জ করার তৌফিক কারও কোনদিন হয়নি! বা টানা এমন আঠার মাস ভবঘুরে জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো ‘আজাইরা’ সময়ও কারও ছিল না বা থাকে না!
এরপর অনেক দেনদরবারের পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন ভারত সরকার তিনবিঘা করিডর ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তাও তিনবিঘায় পুরো অধিকার দেয় না। শর্তযুক্ত চলাচলের অনুমতি দেয়। শর্তটি হচ্ছে, ছিটমহলের বাসিন্দারা প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে এক ঘণ্টা পর পর সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ওই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে যাতায়াত করতে পারবে।
অথচ ছিটমহলবাসীর দাবি ছিল কোনো বিরতি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা তাদের তিনবিঘা করিডর দিয়ে যাতায়াত করার। দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের পর ২০০১ সালের ১১ মার্চ থেকে শুধু দিনের বেলা ১২ ঘণ্টা কোনো বিরতি ছাড়া তিনবিঘা করিডর দিয়ে চলাচলের অনুমতি পাওয়া যায়। কিন্তু আগের মতোই ছিটমহলের বাসিন্দাদের সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই করিডরের ফটকে পৌঁছাতে হতো। ছয়টার একটু দেরি হলেই তারা আর নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারত না ।
তিনবিঘা করিডর শর্তাধীন পাবার পর একবার সেখানে যাবার সুযোগ হয় শেখ হাসিনার সঙ্গে। তখন তিনি বিরোধীদলের নেত্রী। বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে তার জনসংযোগ সফরের সময় সফরসঙ্গী সাংবাদিক দলের সঙ্গে সেখানে যাবার সুযোগ হয়। বাংলাদেশের বিরোধীদলের নেত্রী হিসাবে বিএসএফ সীমান্তে তখন তাকে গার্ড অব অনারও দেয়। কিন্তু সেদিন শেখ হাসিনার জনসভার পর সেখান থেকে চলে আসতে হওয়ায় ঘুরে বেড়ানো হয়নি স্বপ্নের দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতায়!
তবে এর মাঝে সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন, স্কুল-স্বাস্থ্যসেবার কিছু অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু অফিস আদালত, বড় বাজার-সদাই, হাসপাতালসহ জীবনের নানা জরুরি প্রয়োজনে এখনও সেখানকার মানুষজন পাটগ্রাম উপজেলা সদরের উপর নির্ভরশীল।
সবশেষ মনমোহনের সফর আর হাসিনা-মনমোহন চুক্তির পর নতুন জীবন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন দীর্ঘ অবরুদ্ধ-বঞ্চিত জনপদের মানুষজন! নিজের দেশে স্বাধীন ২৪ ঘন্টা অবাধে যাতায়াতের স্বপ্ন! তাইতো চুক্তি স্বাক্ষরের খবরে তারা সেখানে শুকরিয়া মিলাদ-মাহফিল, আনন্দ শোভাযাত্রা করেছেন। আনন্দ সমাবেশে সেখানকার এক স্বভাবকবি পড়েছেন জীবনের স্বরচিত কবিতা-
‘থাকল না আর গেটের চাবি,
আদায় হলো মোদের দাবি;
করিডর থাকবে খোলা ২৪ ঘণ্টা,
ভালো থাকবে সবার মনটা। ’
কিন্তু সেই যে ঘড়পোড়া গরুর মতো এমন একটা আনন্দের সময়েও সেখানকার মানুষজনের মনের শঙ্কা যায়নি! চুক্তি হয়েছে ঠিক, কিন্তু তা কবে-কখন থেকে তা বাস্তবায়ন হবে, কখন থেকে চব্বিশ ঘন্টার জন্যে খুলে যাবে তিনবিঘা করিডোর তা এখনও কোন পক্ষ সাফ সাফ বলেনি! সেখানেই ভয় দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতাবাসীর! কারণ এই জীবনে তারা এমন অনেক চুক্তি-প্রতিশ্রুতি দেখেছেন। তারা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চান। এবং এখনই। সরকারই এখন তাদের ভারতীয় কাউন্টারপার্টের সঙ্গে আলোচনা করে জানাতে পারে কবে আমরা আমাদের নিজস্ব ভূখন্ড দহগ্রাম-অঙ্গরপোতায় যখন-খুশি অবাধে যাতায়াত করতে পারব। পথে আমাদের বেআইনি থামাবে না বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড বা ভারতীয় বিএসএফ!
সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি কবে? কখন?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক