ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্ষমতাসীনের ক্ষমতাহীন প্যারাডক্স

আহমেদ শরীফ শুভ, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১১
ক্ষমতাসীনের ক্ষমতাহীন প্যারাডক্স

যুক্তরাষ্ট্রে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় তখন সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আমরা সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করি। ভাবি হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদল হলে বিশ্ব রাজনীতির বিরাজমান সমস্যাগুলোর যৌক্তিক সমাধান হবে।

ক্লিনটন যায় বুশ আসে, বুশ যায় ওবামা আসে। কিন্তু সমস্যাগুলোর কোন মৌলিক পরিবর্তন হয় না। তার অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে যতোই শক্তিশালী ভাবি না কেন, তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুটি কিন্তু হোয়াইট হাউস নয়, অন্যত্র। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হচ্ছে বিগ বিজনেস, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান আর বহুজাতিক তেল ও অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো। বুশ আর ওবামাদের কাজ হচ্ছে সেই সব ভরকেন্দ্রের তল্পী বহন করা আর তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।

বিশ্বের স্বঘোষিত সর্বোৎকৃষ্ট গণতন্ত্রের যখন এই অবস্থা তখন বিকাশমান গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থাগুলোর পরিস্থিতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সেই অর্থে বিকাশমান গণতন্ত্রগুলো আদৌ বিকাশমান কিনা সেটাই এখন মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিকশিত পুঁজিবাদ যেমন গণতন্ত্রের নামে একটি এলিটিস্ট ডেমোক্র্যাসিকে লালন করছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের বিকাশমান পুঁজিবাদ ও দুর্নীতিবাজ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও তেমনি সেসব দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের টুঁটি চেপে ধরেছে। জনগণ বা তাদের প্রতিনিধিদের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে সুদূর পরাহত।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর জনমনে প্রত্যাশা ছিল যে এত বড় ম্যান্ডেট নিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হতে কোন বাধা থাকবে না। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড আর প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন জাগতে পারে এই সরকারের ক্ষমতার ভর কেন্দ্র কি জনগণ? নাকি অন্য কোন গোষ্ঠী, এই সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি কি প্রধানমন্ত্রী? না কি অন্য কেউ।

যোগাযোগমন্ত্রীর অসততা নিয়ে উকিলিকসে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। এই অভিযোগটি প্রমাণসাপেক্ষ বটে। কিন্তু অভিযোগ যখন উঠেছে অখন জাতি আশা করে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। কই, শিক্ষামন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়েতো উকিলিকস কোনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। উইকিলিকসের প্রতিবেদনের বহু আগে থেকেই যোগাযোগমন্ত্রী সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের তোপের মুখে ছিলেন। তার অব্যাবস্থাপনা আর নিষ্পৃহতা নিয়ে সর্ব সাধারণ ক্ষুব্ধ। তার পদত্যাগ বা পদচ্যুতির দাবি কেবলমাত্র বিরোধী দল থেকেই নয়, উঠেছে খোদ সরকারি দলের তৃনমূল পর্যায় থেকে, দাবি উঠেছে মহাজোটের শরিক দলগুলো থেকে, সরকারের মিত্র বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। এদের কাউকে সরকার বিরোধী বলার অবকাশ নেই, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি বলার সুযোগ নেই কিংবা এটাও বলার উপায় নেই যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এই দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের কোন লক্ষণ বা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

যারা যোগাযোগমন্ত্রীকে জানেন, তারা এটাও জানেন যে তিনি পদত্যাগের পাত্র নন। কিন্তু তার পদত্যাগের দাবি যত জোরালো প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাকে পদচ্যুত করার দাবি ততোটা জোরালো নয়। কেন? প্রধানমন্ত্রী কি তাকে পদচ্যুত করতে পারেন না? তবে অনেকেরই ধারণা পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রীর নাকি তাকে পদচ্যুত করার মতো অবস্থা নেই। বাজারে গুজব তিনি নাকি এই সরকারের চীন–পাকিস্তান লিঙ্ক। তার মেয়ে ‘মেহেরজান’ ছবিটি বানিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছুরিকাঘাত করার জন্য ‘মেহেরজান’ এর চেয়ে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে! স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের সহায়তা আর মদদ ছাড়া এ ধরনের একটি ছবি নির্মাণ হতে পারে না বলেই অনেকে মনে করেন। এই সরকারের পাকিস্তান লিঙ্ক কি এতোই বেপরোয়া? যদি তাই হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষমতা এই সরকারের কতটুকু? ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কি গণভবন? না অন্য কোথাও? আমাদের ক্ষমতসীন প্রধানমন্ত্রী কি সত্যি ক্ষমতাহীন?

বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজি বাজারে কয়েক দফা বিপর্যয় হলো। সঙ্কট সমাধানে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ  নেওয়া হলো না। অর্থমন্ত্রী ক্ষদ্র বিনিয়োগকারী দের ‘ফটকাবাজ’ বলেই খালাস। একটা তদন্ত কমিটি হলো কিন্তু কোনও কার্যকর সমাধান হলো না। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারীর কথিত নায়কদের নিয়ে বাজারে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। একজন কথিত নায়ককে বিদেশগামী বিমান থেকেও নামিয়ে আনা হলো। কিন্তু তারপর সুনসান নীরবতা। কয়েকটি লোক দেখানো বিবৃতি দিয়েই বিরোধী দলের দায়িত্ব খালাস। এ যেন পুঁজিবাজার ধ্বংসের বাইপার্টিজান মহোৎসব। প্রধানমন্ত্রী চেয়ে চেয়ে দেখলেন। কিছুই করতে পারলেন না। তিনি ছিলেন অপারগ। তিনি জানেন এই কারসাজির নায়কেরা তার সরকারের সময় যেমন নিরাপদ, আগামী সরকারের সময়ও তেমনি নিরাপদ।

ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাহীনতার এই সঙ্কট যে কেবলমাত্র যোগাযোগ কিংবা পুঁজি বাজারেই তা নয়। দু’ একটি ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্রই চলছে এই সঙ্কট। নৌ পরিবহন, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র সব জায়গায়ই চলছে এই সংকট। নৌ পরিবহনমন্ত্রীর ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ, বাণিজ্য মন্ত্রীর সামিট গ্রুপ কানেকশনের বাণিজ্যের গল্প এখন ঘরে ঘরে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোথা থকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাও গবেষণার বিষয় বটে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে র‌্যাবের হাতে লিমনের পা হারানোর ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দুঃখ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাতারাতি তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। তবে কি প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান কেউ আছে?

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার দেশপ্রেম আর বিচক্ষনতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। সরকারের ভিতরে বাইরে যা ঘটছে তার অনেক কিছুই যে কেবল দেশ ও জনগণের স্বার্থের বিরোধীই নয় এমনকি খোদ আওয়ামী লীগেরও দীর্ঘ মেয়াদী স্বার্থের পরিপন্থি তা তার না বোঝার কোন কারণ থাকতে পারে না। সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে প্রশাসন পরিচালনায় তার সদিচ্ছাও প্রশ্ন সাপেক্ষ নয়। কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি সকারের লাইনচ্যুত ট্রেনটিকে লাইনে টেনে তুলতে ক্ষমতাহীন কেন?

রাষ্ট্র ক্ষমতার মূল উৎস জনগণকে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া থেকে যে ভাবে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তার অনিবার্য পরিনতিই হচ্ছে সরকার আর সরকার প্রধানের ক্ষমতাহীনতা। প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ও শেষ সার্বভৌম সরকারপ্রধান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার উৎস নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। তারপর এরশাদ ক্ষমতাকে জিম্মি রেখেছিলেন ক্যান্টনমেন্ট আর উঠতি পুঁজিপতিদের হাইব্রিডের কাছে। এরশাদ পরবর্তী তিনটি সরকারই গণবিমুখ এই বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়াকে কেবল অব্যাহতই রাখেনি, বিকাশেও ভূমিকা রেখেছে।

সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন কেনা বেচা হয়েছে প্রকাশ্যে। তৃণমূলে আর মাঠে ময়দানে রাজনীতি করা জন প্রতিনিধিদের বদলে কালো টাকা ‘সাদা’ করা বড় বড় ব্যাবসায়ীরা ঝাঁকে ঝাঁকে দখল করেছে সংসদের আসন। তারা যে জনস্বার্থ না দেখে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণের সচেষ্ট থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের হাতেই এখন ক্ষমতার চাবিকাঠি। ক্ষমতার উৎস জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়েছে বলেই সরকারের ভারত লিঙ্ক, পাকিস্তান লিঙ্ক, চীন লিঙ্ক, মার্কিন লিঙ্ক এমনকি সৌদি লিঙ্কও থাকার দরকার হয়ে পড়ে। ক্ষমতার মূল কেন্দ্র কখনো থাকে খাম্বাতে কখনো দরবেশে, সামিটে, আবার কখনো সেতু কর্পোরেশনে।

খালেদা হাসিনা যেই ক্ষমতাসীন হোন না কেন, প্রকৃত অর্থে তারা থাকেন জনগণের মতোই ক্ষমতাহীনতার প্যারাডক্সে। প্রধানমন্ত্রী বিপুল ক্ষমতাধর এই সব ‘সেতু’র মালিকদের মন্ত্রীত্ব থেকে অব্যাহতি দেবেন কোন শক্তিতে? তিনিতো তার মূল শক্তি জনতার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

shuvo.sharif@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।