‘আমি একজন ভোটার। আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমি আপনাদের ভোট দিলে আমাকে এই এই সুবিধাগুলো দেবেন।
সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে খোদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না নিজেকে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক দাবি করে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের প্রতি ঘরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। আওয়ামী লীগের ইশতেহার-২০০৮ ‘দিনবদলের সনদ’-এর ১৪ নম্বর প্যারায় উল্লেখ আছে, ‘বছরে ন্যূনতম ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেক পরিবারের একজন কর্মক্ষম বেকার তরুণ/তরুণীকে কর্মসংস্থানের জন্য ‘এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি’ স্কিম পর্যায়ক্রমে কার্যকর করা হবে। সকল কর্মক্ষম নাগরিকের নিবন্ধন করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নতুন প্রজন্মের সমুদয় যুব সমাজকে দুই বছরের জন্য ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’-এ নিযুক্ত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। ’
মহাজোট সরকারের দুই বছর আট মাস গেলেও তাদের এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তো হয়ইনি বরং ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। দীর্ঘতর হচ্ছে বেকারের লাইন। দেশে যে হারে বেকারত্ব বাড়ছে তা অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে ২০১৫ সালের মধ্যে বেকারত্ব দেড়গুণ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাড়ছে বেকারের মিছিল
প্রতি বছর বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বের হচ্ছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বাড়ছে স্নাতকধারীর সংখ্যা। কমছে কর্মপরিধি। সংকুচিত হয়ে আসছে চাকরির বাজার।
গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ, কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার কমেছে ২ শতাংশ। আর বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকার হবে ৬ কোটি। এ সময়ে শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), কমনওয়েলথসহ একাধিক সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্ব বাড়ার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ২৭ লাখ আর চাকরি পাচ্ছে মাত্র এর ৭ শতাংশ বা ১ লাখ ৮৯ হাজার। অর্থাৎ প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশকারী বেকার থাকছে প্রায় ৯৩ শতাংশ। এক দশক আগে ২০০০ সালে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। এ সময়ে কর্মবাজারে প্রবেশ করত প্রায় ১৮ লাখ আর কর্মসংস্থানের হার ছিল ১১ শতাংশ।
আইএলওর রিপোর্টে বলা হয়, বর্তমান হারে বেকারত্ব বাড়লে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৬ কোটি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে নতুন কর্মসংস্থান যোগ হয়েছে প্রায় ৩১ লাখ। বর্তমান কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের পর থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমতে থাকে।
লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৮ কোটি। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী লোকের সংখ্যা ৪১ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৪৮ লাখ। এর মধ্যে বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। সার্ভে অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এছাড়া আরও প্রায় ৮৫ লাখ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায়নি। এ ৮৫ লাখকে বেকার ধরলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে শুধু শিক্ষিত বেকারের মোট সংখ্যাই দাঁড়ায় প্রায় ১কোটি।
২০০০ সালের তথ্য অনুযায়ী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ লাখ এবং আন্ডার এমপ্লয়মেন্টের শিকার প্রায় ৫৫ লাখ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ শিক্ষিত বেকার শ্রমবাজারে আসছে, যার মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ৫০ হাজার। তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ চাকরি পেলেও প্রায় ৫৫ শতাংশ থাকছে বেকার বা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না।
এসব পরিসংখ্যান সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমান সরকারের আমলে গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বেকারত্বের পরিসংখ্যান খুবই জটিল। কোনো পরিসংখ্যানেই সঠিক চিত্র উঠে আসে না। তবে সব পরিসংখ্যানের সূচক হচ্ছে বেকারত্ব বৃদ্ধির দিকে। বিশেষ করে প্রতি বছর শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধির চিত্র জাতির জন্য শঙ্কার। শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষার ব্যবস্থা সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। ’
ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব রাষ্ট্রের জন্য ক্রমেই বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপরদিকে সরকারের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেড় লাখের বেশি শূন্যপদ থাকলেও সেখানে নিয়োগ পাচ্ছে না শিক্ষিত বেকাররা।
জানা গেছে, দেশে কত লোক কর্মহীন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যও নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা করা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবক। আর তাদের ৪০ ভাগই বেকার। সে হিসাবে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ঘুরছে কাজের খোঁজে। যদিও সরকারি চাকরিতে দেড় লাখেরও বেশি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় এসব পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
উচ্চশিক্ষা কি কাজে আসছে?
বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করে কেউ চাকরি করছেন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টসে। বুয়েট থেকে স্নাতকোত্তর করে সান্ধ্যকালীন এমবিএ করে কেউ চাকরি করছেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে। বিজ্ঞানের তুখোড় ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে ভর্তি হচ্ছেন ল কলেজে। যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সে বিষয়ে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছেন অন্য সেক্টরে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা এমবিএ করছেন তাদের অনেকেই মানবিক বা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এমবিএ করছেন। এর একটিই কারণ, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন তা তাদের চাকরি নিশ্চিত করতে পারছে না বা বর্তমান চাকরির বাজারে সেসব বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের চাহিদা নেই। তাহলে এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, এসব উচ্চশিক্ষা দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে? এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ৫ বছরের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ পর্বটি কোনও কাজেই আসছে না। ফলে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি জোটাতে প্রার্থীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চাকরি হয়ে পড়ছে সোনার হরিণ। জীবনধারণের জন্য তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীরা সম্পূর্ণ বিপরীত সেক্টরের চাকরিতে ঢুকছেন। চাকরিতে ঢোকার আগে বা পরে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেকে পরিবর্তিত ক্ষেত্রে প্রস্তুত করছেন। বিপরীত সেক্টরে চাকরিরতরা জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা এক্ষেত্রে তাদের কাজেই আসছে না। নতুন কর্মক্ষেত্রে তাই তাদের মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও দক্ষ জনশক্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মাদ্রাসা বোর্ড থেকে উত্তীর্ণদের মধ্যে যারা আলিম পাস করে সাধারণ শিক্ষায় প্রবেশ করছেন তাদের কেউ কেউ উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় এলেও ফাজিল-কামিলে উচ্চশিক্ষা নেওয়া শিক্ষার্থীরাও মূল স্রোতে আসতে পারছেন না। আর কওমি মাদ্রাসায় উচ্চশিক্ষিতরা তো উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নেই বললেই চলে। ধর্মীয় কয়েকটি পুস্তকে তাদের পাঠ সীমাবদ্ধ। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মসজিদে ইমামতির মধ্যে কর্মজীবন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
চাকরিদাতা কে?
বাজেটের বড় একটা অংশ বরাদ্দ থাকে শিক্ষাখাতে। সরকার উচ্চশিক্ষা উৎসাহিত করতে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করলেও উচ্চশিক্ষিতদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ উল্লেখ করার মতো নয়। সরকারি চাকরিতেও উচ্চশিক্ষিতের জন্য অল্পসংখ্যক পদই খালি। এসব পদ পূরণে সরকারি পদক্ষেপও সামান্যই। সরকারি কাজে উচ্চশিক্ষিতদের প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণী, এই দুটি পদকে ঘিরেই চাকরি প্রাপ্তির চেষ্টা থাকে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা হতাশাজনক।
২০০৬ সালে বেসামরিক প্রশাসনে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিরত ছিলেন ৯৩ হাজার ৮৩৯ জন। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার পদ খালি ছিল ২৩ হাজার ৪৩৬টি। একই বছর দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন ৫৩ হাজার ৪৭১ জন এবং পদ খালি ছিল ১ হাজার ৭৩৬৭টি। এর বাইরে সরকারি তৃতীয় শ্রেণীর চাকরিতে পদ খালি ৮২ হাজার ৪৬৬টি।
সরকারি চাকরিতে ২০০৬ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ৪০ হাজার শূন্য পদের বিপরীতে কয়েক লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার ছিল। এই সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৭ সালে সরকারি চাকরিতে কর্মরত ছিল ১০ লাখ ৪৩ হাজার। খালি পদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ। সরকার দাবি করেছে, ২০০৯ সালে প্রায় ৭০ হাজার লোক সরকারি চাকরি পেয়েছে। এছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় উচ্চশিক্ষিতদের জন্য কিছু কর্মসংস্থান হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
শুধু মেধার জোরেই চাকরি জোটে না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন হাসান। স্নাতকে দ্বিতীয় শ্রেণী ছাড়া বাকি সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী। হাসান জানান, সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, মৌখিক পরীক্ষাও ভালো হয় কিন্তু আজ অব্দি তার কাছে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাপয়নমেন্ট লেটার আসেনি। কয়েকটি বেসরকারি প্রাইভেট ব্যাংকেও টানা একবছর ধরে এমন হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
হাসান বলেন ‘চলতি বছরে যে কয়েকটি প্রাইভেট ব্যাংকে অফিসার পদে আমি পরীক্ষা দিয়েছি তার লিখিত ও মৌখিক উভয় পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘অর্থ ও ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই; তাই চাকরি হয়নি। ’ বর্তমানে টিউশনি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে জানান। হাসানের মতো উচ্চশিক্ষিত অনেকেই চাকরি না পেয়ে ভুগছেন হতাশায়। বর্তমানে শিক্ষিত বেকারদের অভিমত, চাকরির ক্ষেত্রে শুধু সার্টিফিকেট থাকলেই হচ্ছে না। প্রায় সব সেক্টরেই নিয়োগ-বাণিজ্য চলছে বলে তাদের অভিযোগ। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একাধিকবার সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া নিরপেক্ষতার সঙ্গে করার জন্য আদেশ ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলের মতো নিয়োগ-বাণিজ্য রমরমাভাবে না চললেও গোপনে এখনও চলছে নিয়োগ-বাণিজ্য।
লেখক : সাংবাদিক
aditya.arafat1@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১১