২০০৭ সালে এক মিসরীয়কে খুন করার অপরাধে ০৭ অক্টোবর ২০১১ তারিখে সৌদি আরবে আট জন বাংলাদেশির জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া অর্থাৎ জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে ।
প্রশ্ন উঠেছে (১) মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে, (২) জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ নিয়ে এবং (৩) আমাদের সরকার ও দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম নিয়েও। আসলে এটা শারিয়া আইন। যারা এ আইনকে বর্বর বলছেন তাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে শারিয়া-সমর্থকেরা চিরকালের মতই সন্দেহ করার স্পর্ধা করছেন।
জানা গেছে, অপরাধীকে ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান-মত করা হয়, এরপর তাকে চোখ বেঁধে জনসমক্ষে এনে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে জল্লাদের তলোয়ারের আঘাতে মাথা কেটে ফেলা হয়। ওই ঘটনায় শিরোশ্ছেদের শিকার আট বাংলাদেশির সঙ্গে দুই সৌদি নাগরিকও আছেন।
ঢাকায় সৌদি রাষ্ট্রদূত দাবি করেছেন, তারা ইসলামি আইন পালন করেন। এনওয়াইবাংলা-তে ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে সৌদি রাজপুত্র নাইট ক্লাবে। এতে তিনি কোন ‘‘আল্লার আইন” পালন করছেন?
তবে এ নিবন্ধে আমি সে আলোচনা করব না। আমার আলোচনা কিভাবে ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ”-কে ইসলামি আঙ্গিকে সমর্থন ও বিরোধিতা করা যায় সেদিকটি নিয়ে।
কোরান-হাদিস থেকে পুরো উদ্ধৃতি দিলে লম্বা হয়ে যাবে বলে শুধু সূত্রের উল্লেখ করছি যাতে মিলিয়ে নেওয়া যায়। বলে রাখা দরকার, যৌক্তিক কারণ ছাড়া অমুসলমানকে হত্যা করা নিষেধ। যদিও সেই ‘‘যৌক্তিক কারণ”টা কি তা সুস্পষ্ট ভাষায় বলা নেই। সাধারণভাবে কোরানে ক্ষমা করে দেওয়াকেই উৎসাহিত করা হয়েছে।
(১) হত্যা করা অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ আছে মায়েদা ৩৩-এ।
(২) শিরশ্ছেদ-এর অনুমতি আছে আনফাল আয়াত ১২ ও মুহম্মদ ৪-এ।
(৩) দিয়াত অর্থাৎ মুসলমানকে অনিচ্ছায় হত্যার ক্ষেত্রে রক্তপণের উল্লেখ আছে নিসা ৯২-তে।
(৪) মুসলমানকে ইচ্ছাকৃত হত্যায় দোজখের শাস্তির উল্লেখ আছে নিসা ৯৩-তে, এখানে পার্থিব শাস্তির উল্লেখ নেই।
(৪) কিসাস অর্থাৎ অপরাধীর সম পরিমাণ শাস্তির (চোখের বদলে চোখ ইত্যাদি)- বাকারা ১৭৮, ১৭৯-তে
(৬) জনসমক্ষে শাস্তির কথা আছে সুরা নূর আয়াত ৪-এ।
(৭) নিহতের পরিবারের (ক্ষমা করার বা রক্তপণ নেবার) অধিকার দেওয়া আছে - বনি ইসরাইল ৩৩-তে।
(৮) ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ”-এর সুন্নাহ আছে সহি মুসলিম ৪৩৬৮, ৪৩৬৯, ৪৩৭০, সহি বুখারি ৪র্থ খণ্ড হাদিস ২৮০, ৫ম খণ্ড হাদিস ১৪৮-এ, ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক-এর ‘‘সিরাত”-এর (রসুলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জীবনী) ৪৬৪ পৃষ্ঠা এবং আরো অনেক সুত্রে। ইবনে সা’দ-এর বিচারে বনু কুরায়জা গোত্রের সুত্রভেদে ৬০০ থেকে ৯০০ বয়ষ্ক পুরুষকে ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ” কার্যকর করেছিলেন নবিজী। বিচারের আগে ইবনে সা’দকে বিচারক হিসেবে বনু কুরায়জা মেনে নিয়েছিল। (এই সুত্রগুলোকে কে বিশ্বাস করবেন কে করবেন না সেটা অন্য বিষয়। )
এই ৮টি সুত্রকে একসাথে করে ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ” শারিয়া আইনকে প্রাথমিকভাবে ইসলামি হিসেবে সমর্থন করা সম্ভব। ইচ্ছাকৃত হত্যার বিচার হতে পারে তিন ভাবে।
(১) আহত ব্যক্তি বা নিহতের পরিবার যদি অভিযুক্তকে ক্ষমা করে তবে রাষ্ট্র তাকে কোন শাস্তি দিতে পারে না।
(২) আহত ব্যক্তি বা নিহতের পরিবার যদি টাকা নিয়ে ক্ষমা করে তবে রাষ্ট্র কোন শাস্তি দিতে পারে না।
(৩) এ দু’টোর কোনটিতে আহত ব্যক্তি বা নিহতের পরিবার রাজী না হলে খুনের জন্য ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ”- কার্যকর হবে। এজন্যই আমাদের রাষ্ট্রপতি সৌদি বাদশাকে খুনীদের ক্ষমা করার অনুরোধে যে চিঠি দিয়েছিলেন তা ছিল ভিত্তিহীন।
সুরা বনি ইসরাইল আয়াত ৩৩ মোতাবেক নিহতের পরিবারের এই অধিকার অত্যন্ত মানবিক বিধান যা ওই গোত্রীয় সমাজে চমৎকার কাজ করেছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই তোষামোদি, সুপারিশ, ধড়পাকড় বা দলীয় ক্যাডার হলে রাষ্ট্রপতি এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনিকেও ক্ষমা করে দিচ্ছেন। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক বিধান। যাদের নিরপরাধ পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পুত্র-কন্যা নিষ্ঠুরভাবে খুন হল তাদেরকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করা হল না অথচ রাষ্ট্রপতি সেই খুনিকে ক্ষমা করে কারামুক্ত স্বাধীন করে দিলেন, এটা নিহতের পরিবারের মনে কেমন লাগবে? এই অত্যন্ত অমানবিক বিধানটা অনেক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে আছে।
যারা ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ” দিয়ে খুন কমানোর স্বপ্নবিলাসে ভোগেন তাদের জানা উচিত বাংলাদেশে এ আইন চালু হলে জনগণের ওপর কেয়ামত নেমে আসবে - খুনের সংখ্যা গুনে শেষ করতে পারবেন না। কারণ দেশে অসংখ্য শক্তিশালী, অর্থশালী ও প্রভাবশালী খুনী গজিয়েছে। তারা গরীব অসহায় নিহতের পরিবারকে টাকা বা হুমকি দিয়ে ‘‘মাফ” করতে বাধ্য করবে এবং সেটা শারিয়াপন্থীরা ঠেকানো তো দূরের কথা টুঁ শব্দও উচ্চারণ করতে পারবেন না। শারিয়ার অনেক আইনের মত (মুরতাদ-হত্যা, পুরুষের ইচ্ছেমত বিয়ে-তালাক, নারীর তালাক নেবার অনধিকার ইত্যাদি) ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ”-ও কেন কোরান-বিরোধী সেটা নীচে দেখুন।
(১) মায়েদা ৩৩, আনফাল ১২ ও মুহম্মদ ৪ তখনকার যুদ্ধের পটভূমিতে নাজিল হয়েছিল, ওগুলোকে বর্তমানের সামাজিক খুন-জখমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাটা সঠিক নয়।
(২) ‘‘জনসমক্ষে শাস্তি”’র আয়াত সুরা নূর আয়াত ২ - এটাও শুধুমাত্র ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, হত্যার ওপরে নয়। শারিয়া আইনে সেটাকে খুনের মামলায় টেনে এনে কোরাণ-লঙ্ঘণ করেছে।
(৩) ‘‘মাফ করা”র এই আইন পাকিস্তানে নরক সৃষ্টি করেছে। সেখানে কোনও মেয়ে যদি কারো প্রেমে পড়ে কিংবা তার বাবা-ভাই যদি সন্দেহও করে, তবে তাকে তার নিজের বাবা-ভাইয়ের হাতেই খুন হতে হয়, যাকে বলে ‘‘অনার কিলিং”। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এভাবে হাজার হাজার মেয়ে খুন হয়। এই মামলায় পরিবার খুনিকে ‘‘মাফ” করে দেয় কারণ তারা মেয়েকে তো হারিয়েছেই, পরিবারের আরেকজন সদস্যকে খুনের মামলায় ফাঁসিতে হারাতে চায় না।
(৪) আগেই বলেছি বাংলাদেশের মত মুসলিম-প্রধান দেশে এ আইন চালু হলে গরীবের ওপর কেয়ামত নেমে আসবে। কারণ এসব দেশে অসংখ্য অত্যাচারী খুনী গজিয়েছে যাদের টাকা পয়সা অঢেল, যারা হিংস্র বাহিনী পোষে, যাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে এবং যারা নিজ এলাকায় মহাসম্রাট। এরা অনায়াসে খুন করে নিহতের গরীব অসহায় পরিবারকে টাকা দিয়ে বা হুমকি দিয়ে ‘‘মাফ” করতে বাধ্য করবে, রাষ্ট্র বা শারিয়াপন্থিরা সেখানে কিচ্ছু করতে পারবে না।
(৫) অনেক শারিয়া আইনের মত মাফ করার এ আইনও চরম নারী-বিরোধী। প্রমাণঃ - ‘‘নিহতের পুত্র থাকিলে কন্যা মাফ করিতে পারিবে না” - শারিয়া দি ইসলামিক ল’ - ডঃ আবদুর রহমান ডোই – পৃষ্ঠা ২৩৫। ‘‘মাফ করিতে পারিবে না’’ মানে কন্যারা নিহতের রক্তপণও দাবি করতে পারবে না।
(৬) বনু কুরাইজা’র ঘটনা অত্যন্ত বিতর্কিত। এ ঘটনার বিপক্ষে অনেক দলিল আছে যা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। যেসব দলিল এ নৃশংস ঘটনাকে রসুলের নামে ইসলামি হিসেবে বৈধ করেছে সেগুলোকে অস্বীকার করার অধিকার আমাদের আছে এবং এবং আমরা সেই দলিলগুলোকে অস্বীকার করি।
(৭) সবচেয়ে বড় কথা এবারে বলি। সমাজের বিবর্তন একটা প্রবল বাস্তব, সেই বিবর্তনের সাথে সাথে মূল ইসলামি মুল্যবোধ বজায় রেখে সামাজিক আইনগুলো বিবর্তন করার চমৎকার নির্দেশ এবং অনেক প্রমাণ আছে কোরানে, আছে রসুলের হাদিসেও। কোরান-হাদিসের সেই গুরুত্বপুর্ণ নির্দেশ লংঘন করেছেন শারিয়া-গুরুরা। কারণ তাতে ইসলামের নামে নারী-নিপীড়ন বন্ধ হয়। সেই সমাজে পাথর বা তলোয়ার ছাড়া অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব ছিল না কিন্তু আমরা সেই যুগে বাস করি না। এখনকার মানবাধিকার সচেতন পৃথিবীতে ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ” বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়।
কোরানের অনেক বিধানই তাৎক্ষণিক এটা শারিয়া-গুরুরাও স্বীকার করেন এবং এখন তা বাতিল ঘোষণা করেন যেমন (১) দাসপ্রথা (অনেক আয়াত) (২) দাসীর সাথে সহবাসের অধিকার (মুমিনুন ৫,৬) (৩) অমুসলিমদের কাছে থেকে জিজিয়া কর নেয়া ইত্যাদি। সেই হিসেবটা তারা এক্ষেত্রে করতে নারাজ, তার কারণ আছে। কোরানের ওই নির্দেশগুলো তারা ইচ্ছে করে বাতিল করেন নি, করেছেন যুগের প্রগতিতে বাধ্য হয়ে। এখনো আমাদের শুনতে হয় ‘‘দাসপ্রথা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ এবং সেটা শুনতে হয় কোন কাঠমোল্লার কাছ থেকে নয়, মওদুদি ও শীর্ষ সৌদি শিক্ষাবিদ ডঃ ফওজানের কাছ থেকে। এ আইনও ভবিষ্যতে বাতিল হতে বাধ্য।
ইসলামের মূল্যবোধ বজায় রেখে সামাজিক আইনকে পরিবর্তন করার ইসলাম মেকানিজমটা কোরান-রসুল দিয়ে গেছেন; বিস্তারিত দেওয়া আছে আমার ‘‘শারিয়া কি বলে আমরা কি করি” বইতে। এই চমৎকার মেকানিজমটা তারা উপেক্ষা করেছেন ১৪০০ বছর ধরে, - ফলে বিশ্ব-মুসলিমের বিশেষ করে মুসলিম নারীদের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে।
শারিয়া আইনে গোত্রীয় প্রভাব প্রবল, এ আইনটা হয়ত সেই সময়ের সমাজের উপযোগী করে দেওয়া হয়েছে যেখানে ‘‘জনসমক্ষে শাস্তি” একটা কার্য্কর প্রথা ছিল। এখন মানবাধিকার সচেতন দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে এটা অবশ্যই একটা বর্বর প্রথা। তাছাড়া এ প্রথা খুন-জখম কমাতে সম্পুর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। যারা এ আইন দিয়ে খুন কমানোর স্বপ্নবিলাসে ভোগেন ও এ আইনের বিরোধীদেরকে গালাগালি করেন তাদের জানা উচিত এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত ‘‘জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ”-এর সংখ্যা ওই সৌদি আরবেই ৫৬ জন, এবং এ সংখ্যা গত বছরের দ্বিগুনেরও বেশী ছাড়িয়ে গেছে - (বিবিসি)। তাহলে আর ‘‘জনসমক্ষে শাস্তি” দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানের ভাবমূর্তি নষ্ট করা ছাড়া লাভ কি হল?
বিচার-ব্যবস্থা হল অপরাধের বিরুদ্ধে মানবতার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। একটা দেশের শাস্তি-প্রদানের পদ্ধতি সেই জাতির সাংস্কৃতিক অগ্রগতির মাপকাঠি। প্রতিবাদের ভাষা প্রতিবাদীর চরিত্র নির্দেশ করে - এ ব্যাপারে শারিয়া-রাষ্ট্রগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
hasan.mahmud@hotmail.com
Website- hasanmahmud.com
[লেখক ওয়ার্লড মুসলিম কংগ্রেস-এর উপদেষ্টা বোর্ড ও আমেরিকান ইসলামিক লিডারশিপ কোয়ালিশন-এর সদস্য, দ্বীন রিসার্চ সেন্টার, হল্যাণ্ড -এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ফ্রিমুসলিম কোয়ালিশন-এর ক্যানাডা-প্রতিনিধি এবং মুসলিম ক্যানাডিয়ান কংগ্রেস-এর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও ডিরেক্টর অফ শারিয়া ল। ]
বাংলাদেশ সময় ১৮২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১১