ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কী তা দেশ?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১
তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কী তা দেশ?

এই প্রথম একটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হচ্ছে যখন রায়ের বাজার বধ্যভূমি থেকে তোলা সেই বিখ্যাত ছবির অমর  আলোকচিত্রগ্রাহক রশীদ তালুকদার আর আমাদের মাঝে নেই! জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নেই! চল্লিশ বছর ধরে যে তিনি অনুজ শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীসহ মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন, হঠাৎ করে তিনি নেই! এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। অথচ এখনও দাপটে দিব্যি বহাল আছে একাত্তরের ঘাতক দালাল খুনি রাজাকার তাদের দোসর সহযোগীরা!

১৩ ডিসেম্বর একটি নিউজ সচিত্র প্রচার হয়েছে বাংলানিউজসহ দেশের সব নিউজ পোর্টালে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের পত্রিকাতেও খবরটি আছে। আইন প্রতিমন্ত্রীসহ কয়েকজনকে মুরতাদ ঘোষণা করেছে মুফতি ফজলুল হক আমিনী! এই একটি খবর আঙ্গুল উঁচিয়ে যেন মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তে পাওয়া আমাদের রাষ্ট্র আজও কী অসহায়! সংবিধানের নামে শপথ নেওয়া দু’জন কেবিনেট মেম্বারকে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বেআইনিভাবে বিধর্মী ঘোষণা করছে এক মোল্লা! যে আবার দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কিন্তু এ ধরনের একটি বেআইনি তৎপরতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না! একাত্তরের শহীদেরা এমন একটি দেশের জন্য কী জীবন দিয়েছিলেন?
 
চলতি আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের অনেক কিছু নিয়ে অনেকের দ্বিমত অথবা ভিন্ন মতামত আছে। কিন্তু তাকে মুরতাদ বা বিধর্মী ঘোষণার জন্য আমিনী কে? বা এটিইতো এ ধরনের ঘটনা না। হিসাব করে দেখুন গত কয়েক বছরে এই একজন মুফতি ফজলুল হক আমিনী এখন পর্যন্ত দেশের বিচারপতি-মন্ত্রী-এমপি-বুদ্ধিজীবী-লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক থেকে শুরু করে কতজন বিশিষ্ট নাগরিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের উস্কানিমূলক ঘোষণা দিয়েছে? গ্রামের গরিব অসহায় নারী-পুরুষদের বিরুদ্ধেতো আমিনী গংদের ফতোয়াবাজির কোন হিসাবেরতো লেখাজোখা নেই! রাজধানীবাসী প্রভাবশালী সাংবাদিক পদমর্যাদার হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টের বিচারক, মন্ত্রী-এমপি, লেখক-অধ্যাপকরা যেখানে অসহায় সেখানে গ্রামের লোকজনের অবস্থা ধারণা করা যায়।

অথচ এই আমিনীও একজন স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার। একাত্তরে রাজমিস্ত্রির কাজ করার পশাপাশি করতেন দেশের বিরুদ্ধে রাজাকারি। তাদের পাকিস্তান-স্বপ্নকে পরাভূত করে বাঙ্গালি চেয়েছিল মুক্তচিন্তার একটি দেশ। একাত্তরে তারা হারলেও  উল্টো তারাই যেন আজ দেশের মানুষকে পরাজিত করে বসে আছে! এই আমিনীকে কোর্টে ডাকলে কারা তার পক্ষে দাঁড়ায়, কারা ঘটায় কী সব লঙ্কাকাণ্ড? তারাও কী বাংলাদেশকে করতে চান মোল্লা আমিনীর স্বপ্নের পাকিস্তান? তা অবশ্য না। কারণ তা করলেতো আবার হারাম হয়ে যায় ম্যাডামের হালাল নেতৃ্ত্ব! অথচ উস্কানি যা দেবার তা ঠিকই চলে! ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব পোষার পরিণতি কী হয়? এসব কী উনাদের পড়াশুনা আছে না লাগে?
 
মিসরের কায়রোতে সাইয়েদিনা বলে একটি এলাকা আছে। হযরত ইমাম হোসেন(রাঃ)’র মস্তকের সমাধি সেখানে। হযরত মোহাম্মদ(দঃ) এর বংশধররা ওই এলাকায় থাকেন। মিসরে এরা খুবই সম্মানিত সাইয়েদিনা সম্প্রদায়। এ সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত। অনেকে ছোটবড় ব্যবসা করেন। এর মানে কাজ ছাড়া কেউ নেই। সম্প্রদায়গত সম্মান-মর্যাদা রাখতে তারা কখনো সেখানে রাজনীতির সঙ্গে জড়ান না। রাষ্ট্রীয় কোনও সুযোগ সুবিধা নেন না। ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী সহ নানান রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে রাষ্ট্র তাদের সম্মান দেয়।
উল্লেখ্য, আমাদের যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস তেমনি মিসরের প্রধান রাষ্ট্রীয় দিবস ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী।

কায়রোর এই সাইয়েদেনা সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে সরেজমিন মেলামেশার সময় আমাদের দেশের আমিনীদের কথা মনে পড়েছে। নিজস্ব নিরাপদ কাজ-পেশা থাকার কারণে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে গুরুত্বপূর্ণ সাইয়েদেনা সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে কারো দয়ার ওপর নির্ভরশীল নন। আমাদের আমিনীরা নির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী। দেশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলে প্রথম সোজা যে জবাব পাওয়া যাবে, এরাতো কাজ করে না। পরের দানদক্ষিণায় চলে। পরের বাড়ি দাওয়াত খেয়ে বেড়ায়। হৃষ্টপুষ্ট হয়। আমিনীদের সবাই হয়তো এমন না। কিন্তু তাদের ব্যাপারে দেশের বেশিরভাগ মানুষের এটিই সাধারণ ধারণা।

আরেকটি বাস্তব-সত্য নির্বাচনী রাজনীতিতেও এরা পরনির্ভরশীল। নির্বাচনে যদি জোটের একটি মনোনয়ন পেয়ে এমপি হওয়া যায় সে আশায় এরা কোনও একটি জোট করে। এমনিতে বাংলাদেশের কোথাও একা নির্বাচন করে ভোটে জেতার কোনও যোগ্যতা সামর্থ্য তাদের নেই। তারা যাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয় তারা কাজ করে, এবং সমাজের নানা শ্রেণী-শাখায় তাদের নিজস্ব অনেক যোগ্যতা আছে। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-স্বপ্ন ছিল যার-যার-ধর্ম-তার-তার থাকবে। রাজনীতিতে ধর্মকে জড়িয়ে ফায়দা লোটার পরিত্যক্ত পাকিস্তানি ধারার আরেকটি ধর্মভিত্তিক দেশ হবে না বাংলাদেশ। লাখো শহীদের আত্মাহুতির বিনিময়ে কেনা দেশ আজ লক্ষ্যচ্যুত। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনের সঙ্গেও এসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আপোস করেছে আওয়ামী লীগ।
 
বিজয়ের মাসে একাত্তরের ঘাতক দালালদের একটি কৌশলের কাছেও হেরেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজে নিয়োজিত ট্রাইবুন্যাল! সবার অপেক্ষা ছিল এবার বিজয় দিবসের আগেই গ্রেফতার হবে ঘাতককূল শিরোমনি গোলাম আযম। সরকারের মন্ত্রীরাও তেমন আশা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আইনজীবী মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক (খাজুর) তার গ্রেফতার বিলম্বিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এমনিতে মার্চ-ডিসেম্বর মাসে একটু সাবধানে চলে, কথা বলে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। এর দাগীরা পারলে গর্তে ঢুকে নিরাপদ সময় কাটায় কয়েকদিন। গতবছর বিজয় দিবসের আগে আরেক দুর্ধর্ষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এবার বিজয় দিবস উদযাপন হবে গোলাম আযমের গ্রেফতারের মাধ্যমে, এমন অপেক্ষায় ছাই দিতে পেরেছেন ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের উকিল রাজাকার ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক! ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকার বাইরে থাকবেন এ কথা বলে ট্রাইব্যুনাল থেকে তিনি সময় নেওয়া বা প্রত্যাশার গ্রেফতার বিলম্বিত করতে পেরেছেন! তা ট্রাইব্যুনাল কি এখন নিরপেক্ষ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক খাজুর? (সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় খেজুরকে বলা হয় খাজুর। যেমন লিচুকে বলা হয় লেছু। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের ডাকনাম খাজুর। যা সম্প্রতি তার এলাকার একজন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। সঙ্গে জানা গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার চট্টল জীবনের তথ্যাদি!)।
 
তোমাদের যা বলার ছিল বলছে কী তা বাংলাদেশ? ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতাদিবসে কবিতার এ প্রশ্নটি জোরের সঙ্গে আলোচনায় আসে। নাহ, এখনও তা বলছে না। এই বাংলায় এখনও দাপটে ঘুরে বেড়ায় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি, তাদের দোসর আণ্ডাবাচ্চারা। চল্লিশ বছরের সরকারগুলোর নানা ব্যর্থতায় দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ সম্পদশালী। একাত্তরের অপরাধের শাস্তি থেকে বাঁচতে তারা বিদেশি উকিল ভাড়া করে আনতে চায় বা সে সামর্থ্য রাখে। আর মুক্তিযোদ্ধা সে দেশে উল্টো দুঃস্থ! রাষ্ট্রের দয়ার সামান্য ভাতানির্ভর তাদের জীবন! অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটে শহীদজায়া-মাতাদের! অতএব বাংলাদেশ এখনও তোমাদের কথা বলছে না। তবে বলবেই। সামনে। সব ‘ধানাইপানাই’র সাঙ্গ হবেই। কারণ আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত, এরক্ত কোনওদিন পরাভব মানে না।
 
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১১০৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।