ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জনসংখ্যা বোনাসের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ

ড. শামসুল আলম, সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১
জনসংখ্যা বোনাসের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ

samsulসম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যের হারের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। ভূমিও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে স্বাধীনতার পরেও সেদিনের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা ছিল দেশের বহন ক্ষমতার বাইরে।

দারিদ্র্যের হার ছিল ৮০ শতাংশ। আজকের জনসংখ্যা স্বাধীনতা উত্তর কালের তুলনায় এখন দ্বিগুণ। এখনো প্রতি বর্গকিলোমিটারে যে জন ঘনত্ব, বলা হয় তাবৎ দুনিয়ার সকল জনগোষ্ঠিকে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করা হলে, তারপরেও বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব হবে যুক্তরাষ্ট্রেরও বেশি। পৃথিবীর ১৯০টি দেশের মধ্যে (শহর কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ছাড়া) বাংলাদেশের জনঘনত্বই সবচেয়ে বেশি।

আজকের সমাজ ও অর্থনীতিতে যত সমস্যা-এসব মূলতঃ জনসংখ্যার ক্রাউডিং সমস্যা। অতীতে আমাদের রাজনীতিকদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ না করতে পারা। অর্থনৈতিকভাবে, দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্জন গত ৪০ বছরে অত্যন্ত প্রশংসনীয়। খাদ্য উৎপাদন সাড়ে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ জনসংখ্যা অব্যহত বৃদ্ধির কারণে খাদ্যসহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে এখনো দেশ প্রতিবছর ঘাটতিতে এবং কোটি কোটি টাকা আমদানীতে ব্যয় করতে হচ্ছে। জনসংখ্যা কম বা পরিমিত থাকলে-শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনসংখ্যাকে আরো বেশি উৎপাদনশীল স্বাস্থোন্নত কর্মক্ষম ক্ষিপ্র জাতিতে পরিণত করা যেত।

পনের কোটি লোক হয়েও আমাদের বিদেশে শ্রমিক কর্মরত আছে ৬৫ থেকে ৭০ লক্ষ। অথচ পাঁচ কোটি জনসংখ্যার ফিলিপাইনে দেশের বাইরে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লক্ষ, আর বার্ষিক প্রবাসীদের পাঠানো আয় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আমাদের বার্ষিক প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের দ্বিগুণ। ওদের জনসংখ্যা কম বিধায় প্রশিক্ষিত ও ভাষায় দক্ষ করা গেছে। সম্পদের ঘাটতিতে সবাইকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত ও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দুনিয়ার অন্য কোথাও জনসংখ্যার জন্য স্থানাভাব নেই। আমাদের তা প্রচণ্ড।

প্রতিবছর নিট ৮২ হাজার হেক্টর জমি শুধু নতুন বাড়ি ঘর তৈরীতে চলে যাচ্ছে। চাষের জমি সংকুচিত হচ্ছে। শিল্প-কলকারখানা গড়ার জমি দু®প্রাপ্য। এখানে শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের বড় সমস্যা হচ্ছে প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়া, কিংবা পেলেও ব্যয় ক্রয় সাধ্যের বাইরে। মালয়েশিয়ার সাড়ে তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের দেশে মানুষের সংখ্যা সোয়া দুই কোটি। ঐ সব দেশের জন্য জন মেনার্ড কীনস্ ও আর্থার লিউইসের জনসংখ্যা তত্ত্ব প্রযোজ্য। আর আমাদের দেশের জন্য ম্যালথাস তত্ত্ব পূরোপূরি প্রযোজ্য। জন মেনার্ড কীনস্ এর তত্ত্ব হল জনসংখ্যা হচ্ছে সম্পদ। জনসংখ্যা যত বাড়বে, দেশের এগ্রিগেট ডিমান্ড তত বাড়বে এবং সে সুযোগে পুঁজিপতি, শিল্পপতি, বড়জোতদাররা পণ্যের সরবরাহ বাড়াবে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ লিউসের তত্ত্ব হল, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক সরবরাহ বাড়বে এবং প্রকৃত মজুরী কমবে। এবং এই স্বল্প মজুরীর কারণে পুঁজিপতিদের অধিক মুনাফা নিশ্চিত হবে এবং ঐসব মুনাফা আবার পুনঃ বিনিয়োগ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

রবার্ট ম্যালথাসের মূল বক্তব্য হচ্ছে অংকের নিয়মে খাদ্য সরবরাহ বাড়বে (১, ২, ৩, ৪, ৫... এভাবে) এবং জনসংখ্যা বাড়বে জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮, ১৬...হারে)। এবং এক সময় সম্পদ ও খাদ্যের ঘাটতি হবে এবং প্রকৃতির জন্য বোঝা স্বরূপ হবে। প্রকৃতি পতিশোধ নিতে বান, বন্যা, মহামারিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দমিয়ে রাখবে। এবং জনগণও নিজেরাই নিজেদের জন্য মারমুখি হয়ে উঠবে। এ কারণে ম্যালথাস জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে তিনি এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। এই তিন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদদের কোন পর্যায়ে কে কতটা প্রাসঙ্গিক ও সত্য, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে বহুলাংশে বাংলাদেশে ম্যালথাস যে সত্য তা বোধ হয় অস্বীকার করার সুযোগ কম। আমাদের দেশ ভৌগলিকভাবেই একটি ক্ষুদ্র দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ অনুল্লেখ্য এবং সীমিত। পরিকল্পনার বাইরে জনসংখ্যা হতে থাকলে আমাদের জন্য ম্যালথাস তত্ত্ব শতভাগ সত্যে পরিণত হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। দ্রুতই বাড়ি-ঘরের স্থানাভাব ও সুপেয় পানি সংকটে আমাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।

যদি স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যাকে ১০ কোটি জনসংখ্যাতেও ধরে রাখা যেত, আমরা ২১ শতক শুরু হওয়ার পূর্বেই খাদ্য রপ্তানীকারক দেশে পরিণত হতাম। খাদ্য আমদানীর টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত আরো উন্নতি হত। আমরা এত দিনে মধ্যম আয়ের উন্নত দেশে পরিণত হতাম। অবশ্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একেবারে যে অগ্রগতি হয়নি তা নয়। স্বাধীনতার পর প্রতি মা গড়ে জন্মদিত ৬ দশমিক ৫টি সন্তান। এখন প্রতি মা গড়ে সন্তান জন্ম দিচ্ছে ২ দশমিক ৫টি সন্তান।

রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও উৎসাহ পেলে এবং দারিদ্র্য সংখ্যার নীচে যে সমস্ত পরিবার তাদের ঘিরে ব্যাপক কর্মসূচি পরিচালিত হলে, প্রতি মায়ে গড়ে অন্ততঃ ২টি সন্তানে নামিয়ে আনা খুব কঠিন কিছু নয়। জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশে একটি কার্যকর প্রণোদনামূলক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সর্ব মহলে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিও প্রয়োজন। রাষ্ট্রিয় পরিচালনায় থাকা প্রয়োজন জনকল্যাণে বিশ্বাসী একটি প্রগতিকামি অগ্রসর শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বশীল শক্তি। এই জনসংখ্যার আধিক্যের মধ্যেও জনসংখ্যাকে কাজে লাগানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশে শুরু হতে যাচ্ছে ২০১২ সাল থেকে। সর্বোচ্চ কর্মোপযোগী এবং সবচেয়ে কম নির্ভরশীল একটা জনগোষ্ঠি  এই সময়ে পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কোন একটি রাষ্ট্র জনসংখ্যা পরিবর্তনে এ সুযোগ একবারই পেয়ে থাকে। যে সময়টাকে বলা হয় জনসংখ্যার ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যার বোনাস কাল। অর্থাৎ, জনগোষ্ঠির সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা থাকে ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এক থেকে ১৫ নীচে বয়সি জনসংখ্যাও কমতে থাকে এবং ৬৪ এর উপর জনসংখ্যা থাকে সবচেয়ে কম। মানে এই সময়টাতে সবচেয়ে কম থাকে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠি, সবচেয়ে বেশি থাকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা। এই সর্বোচ্চ কর্মক্ষম জনসংখ্যার কালকেই বলে জনসংখ্যা বোনাসের কাল।

পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে এই জনসংখ্যা বোনাসের কাল শুরু হয়েছিল তিন দশক পূর্বে। এখন সে সময় শেষ হয়ে বার্ধক্য জনসংখ্যার হার বাড়ছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যা বোনাসের এই সর্বোচ্চ কর্মক্ষম জনশক্তিকে সঠিক কাজে লাগাতে পারলে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটাতে পারে। ষাটের উপর এখন জনসংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ। পয়ষট্টি বছর বয়সের উপর জনসংখ্যা মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। নির্ভরশীল সংখ্যা এক সময় অনেক বেড়ে যাবে যা ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার এই আধিক্য ২০১২ থেকে শুরু হয়ে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বিরাজ করবে। এই ‘কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুযোগের জানালা’ বা জনসংখ্যার বোনাস ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত কোন কোন দেশে বিরাজমান থাকে। এরপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। অত্যন্ত শুরুত্বের সংগে কর্মমুখি জনসংখ্যার এই যে ডিভিডেন্ড তাকে অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে হবে। এই সুযোগকে কোন ভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবেনা। রাষ্ট্র পরিচালক, সমাজবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সংবাদকর্মি, এনজিও সংগঠক সবাইকে এই সুযোগের সদ্বব্যবহারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালকদেরকেই নিতে হবে অগ্রণী ও ইতিবাচক ভূমিকা। সর্বাধিক কর্মক্ষম এই জনগোষ্ঠিকে সর্বাধিক কাজে লাগাতে হলে চাই প্রচুর কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও কাজ সৃষ্টির পরিবেশ। এর জন্য প্রয়োজন সংঘাতমূলক রাজনীতি পরিহার করে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে অক্ষুন্ন রাখা। ব্যক্তি উদ্যোগকে সর্বোচ্চ সুযোগ দেয়া যাতে, প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে অবকাঠামো সৃষ্টিতে সর্বাধিক সরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং খাতকে যুক্তি সঙ্গতভাবে সম্প্রসারণ ঘটানো। শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে, বিশেষভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত ও ব্যবহারিক উপযোগিতার দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া। বিভক্ত সমাজ যাতে তৈরি না হয় সেজন্য বিভিন্ন শিক্ষা-ধারাকে জাতীয় একমুখি শিক্ষায় সংযুক্ত করা। সবার মাঝে আতœবিশ্বাস সৃষ্টির জন্য ও আয় বৈষম্য কমিয়ে রাখার প্রয়োজনে-দুর্নীতিদমনে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালানো। সুপরিকল্পিতভাবে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যের এই বোনাস, জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে। রাষ্ট্র নায়কদের উচিত হবে না, জনসংখ্যার বোনাসের এই সুযোগকে হাত ছাড়া করা।

লেখকঃ অর্থনীতিবিদ ও সদস্য, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ,

পরিকল্পনা কমিশন
    
                                                             
sabau47@yahoo.com  

বাংলাদেশ সময় ১১৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।