ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শারীরিক দূরত্বে থাকি, সামাজিক দূর‍ত্বে নয়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৪ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০২০
শারীরিক দূরত্বে থাকি, সামাজিক দূর‍ত্বে নয়

দার্শনিক এরিস্টটলের ভাষায় ‘মানুষ সামাজিক জীব’। মানুষ কখনো একা বাস করতে পারে না। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ অবধি ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই একে অপরের সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে দলবদ্ধ ভাবে বসবাস করে আসছে, যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে সমাজ। সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাষায় পারস্পারিক সহযোগিতা ও মিলেমিশে বসবাস করার নামই সমাজ। একই বক্তব্য সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের, ‘যে সব সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমরা জীবনধারণ করি, সেসব সম্পর্কের সংগঠিত রূপ হলো সমাজ।’

আরও বহু সমাজবিজ্ঞানী সমাজের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এমনই কাছাকাছি বিষয়কে ইঙ্গিত করেছেন, যার মোদ্দাকথা হলো, মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করেই আজকের এই সভ্য সমাজের রুপ দিতে পেরেছে।

এই সমাজ ব্যবস্থা যে শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সেটাও না বরং সামান্য মনোযোগী হলেই আমাদের চোখে পড়বে সব প্রাণীকুলেই এই সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান।

এ ক্ষেত্রে মৌমাছি বলি আর ক্ষুদ্র পতঙ্গ পিঁপড়াই বলি না কেন, সেটা সব জায়গায় বিরাজমান।

মোটকথা, একে অপরের সুখে দুখে, বিপদে আপদে পাশে থাকা, এক সাথে শত্রুর মোকাবেলা করা, রোগে শোকে কাছে থাকা, সাধ্যমতো সহযোগিতাই এই সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য। অথচ আজকাল আমরা ব্যাপক আকারে একটি কথার সাথে প্রতিদিন মুখোমুখি হচ্ছি যা হলো, ভাল ও সুস্থ্য থাকতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

বর্তমান বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছে এক অদৃশ্য দানব কভিট-১৯ যা সোজা কথায় বলা হয় করোনা ভাইরাস। সারা পৃথিবী নতজানু হয়ে পড়েছে তার আক্রমণে। মহা শক্তিধর পরাশক্তি দেশগুলোও আজ অসহায়, এমনকি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

ইতোমধ্যে দেশের পর দেশ, শহরের পর শহর একে একে লকডাউন করা হয়েছে। শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে খাদ্য উৎপাদন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে প্রায় নিথর হয়ে পড়েছে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দিশেহারা মানুষ আজ ঘরবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে চিকিৎসা, খাদ্য সংকটের সম্মুখীন সেখানে নিম্ন আয়ের নির্ভরশীল দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সহজেই অনুমেয়। এ সব দেশের একটি বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতিতে একদিকে উৎপাদন বন্ধ, অন্যদিকে আমাদানি রফতানি তলানীতে। এর মধ্যে দেশের আয়ের অন্যতম খাত বিদেশি রেমিট্যান্সও ঝুঁকির মুখে। ঝুঁকির অগ্রভাগে রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার আতুরঘর ব্যাংক খাতও। এত কিছুর পরেও সরকার তার সীমিত সক্ষমতা নিয়ে এই দরিদ্র দেশের মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান কীভাবে স্বাভাবিক রাখা যায় তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বেশকিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথে থাকলেও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বা দাঁড়িয়েছে সামাজিক দূরত্ব।

মানুষের সামাজিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ব বোধের অভাবের কারণেই এই সামাজিক দূরত্ব আজ সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ফলে ত্রাণের চাল চুরি, বাড়িওলা কর্তৃক ভাড়াটিয়া নিগৃহীত, সন্তান মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, আক্রান্তকে দাফন করতে না দেওয়া, ত্রাণের কথা বলে ধর্ষণসহ যত অমানবিক, অসামাজিক কাজ আছে সবই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা যেন সত্যি সত্যি সামাজিক দূরত্বে চলে যাচ্ছি।

আজ থেকে ছয় মাস আগেও যে নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা মানুষ ভাবেনি আজ তাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা এখনও হয়তো নিশ্চিত না আগামী ছয় মাস পর কী হতে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই মহামারি থেকে এত দ্রুত হয়তো পৃথিবী মুক্তি পাবে না, ভয়ানক মহামারির আশঙ্কার কথা সতর্ক করে দিচ্ছে বিজ্ঞানী এবং অন্যন্য আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো। সে হিসেবে বিশ্ব দেখতে পারে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মত খাদ্য সংকট, আশানুরূপ ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হলে চিকিৎসকরা যে হারে আক্রান্ত হচ্ছেন তাতে চিকিৎসা সেবাতেও মানবিক সংকট তৈরি হবে সেটাও সুনিশ্চিত। সে হিসেবে মানব সভ্যতার গতি শুধু থেমেই যাবে না বরং পিছিয়ে দেবে কয়েক দশক। আর এজন্য আমাদের উচিৎ এখনই ভবিষতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানবিক বা সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা করা। তাত্ত্বিকদের ভাষায়, ‘পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সমাজ কাঠামো’ সেই কাঠামোকে শক্ত করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে লড়তে হবে কভিট-১৯ দানবের বিপক্ষে। সরকারের একার পক্ষে এ লড়াই করা সম্ভব নয়। তাই যার যতটুকু আছে তাই নিয়ে অন্যের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়ানো। চিকিৎসকরা যেমন তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীকে সেবা দিচ্ছেন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জীবনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। ঠিক একই ভাবে ব্যাংকারগণ এবং মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক ইউনিট যার যার জায়গা থেকে পেশাদারিত্বের সাথে এই দানব মোকাবেলায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাই সমাজের ধনাঢ্যদের উচিৎ তাদের জায়গা থেকে সামাজিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসা। একইভাবে ব্যবসায়ী শ্রেণীও যেন তাদের সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন সেদিকে মনোযোগী হওয়া।  

অন্যদিকে, সমাজের সদস্য হিসেবে প্রত্যেক সদস্যের উচিৎ কুসংস্কার দূরে ঠেলে সরকারি নির্দেশনা পালনের সাথে পরস্পরের সাথে মানবিক আচরণ করা, খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আত্মনির্ভরশীল খাদ্য বলয় গড়ে তোলা। সেই সাথে স্বাস্থ্য বিধি মেনে একে অপরের সহায়তায় এগিয়ে আসা।

মনে রাখতে হবে, সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে সমাজের সবাইকে নিয়ে ভাবা উচিত। সবার উন্নতি এবং মঙ্গলের কথা চিন্তা করাও সামাজিক দায়িত্ব। নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও এগিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে হবে। সমাজের সকল মানুষ এগিয়ে গেলে তবেই সমাজ এগোবে, দেশ ও দশের উন্নয়নের সাথে নিজের উন্নয়ন ঘটবে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমেই আমাদের পক্ষে একজন প্রকৃত সামাজিক জীব হয়ে ওঠা সম্ভব।

তাই মানবিক বা সামাজিক দূরত্ব নয় বরং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই এই দানবকে দ্রুত পরাজিত করতে পারবো ইনশাল্লাহ।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।