ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অভ্যুত্থান পণ্ড হওয়াতে কি খালেদা খুশি হননি?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১২
অভ্যুত্থান পণ্ড হওয়াতে কি খালেদা খুশি হননি?

ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে যে যেভাবে খুশি প্রতিক্রিয়া দিয়ে চলেছেন! সরকারি লোকজন বলছেন, বিরোধীদলের লোকজন বলছেন। যে যার জায়গা থেকে অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে! এগুলোর অনেক কিছুতে দায়িত্বজ্ঞানের অভাব প্রকট।

এর মাঝে প্রকাশ পেয়েছে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে ক্যু-কুশীলবদের ক্ষমতা দখলের খায়েশ ছিল! অবশ্য যে কোনও সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে এমন বন্দুক আর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত। সামরিক অভ্যুত্থান মানেই রক্তপাত। এ রক্তের দাগ হাসিনা-খালেদা দু’জনের ঘরেই আছে। সামরিক অভ্যুত্থানের কুশীলবরাতো গুলতি বা তীর-ধনুক নয়, বন্দুকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এসব কিন্তু পাখি মারার দোনলা বন্দুক নয়। হেভি-অত্যাধুনিক অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু অথবা জিয়াকে হত্যার সময়ও এসব অস্ত্র আমাদের ছিল না। আর এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে আছে বলে আস্কারা পেলে এদের কেউ কেউ যা খুশি ভাবতে গিয়ে মাথা সব সময় ঠিক রাখতে পারে না! এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বলে তারা অভ্যুত্থানকারীদের টার্গেট ছিল। সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান নস্যাৎ করতে পারায় শেখ হাসিনাসহ এর নেতাদের জীবন, দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বেঁচেছে! কিন্তু এখন পর্যন্ত এর পুরো তদন্ত শেষ হতে পারলো না, একপক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে শুরু করে দিয়েছে ব্লেম-গেমের তুমুল প্রতিযোগিতা!
 
বিএনপির পক্ষে অমুক অমুক এর বিরুদ্ধে বলেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, তারা ক্ষমতার গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের পক্ষে। অতীতের সামরিক শাসকদের ধারাবাহিক উকিল ব্যারিস্টার মওদুদও বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে বরে তারা খুশি হয়েছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার এদের কারও কথায় কিন্তু অভ্যুত্থান ব্যর্থ করায় সেনাবাহিনীর প্রশংসা নেই! এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনও কথা নেই বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়ার! ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়ার পর শেখ হাসিনাকে দেখতে সুধাসদনে যেতে চেয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ড ওয়াজেদ আলী মিয়া মারা যাবার পরও তাকে দেখতে সান্ত্বনা দিতে ছুটে গেছেন। কিন্তু এবার একটি সামরিক অভ্যুত্থান পণ্ড হওয়ায় যে শেখ হাসিনার জীবন বাঁচল, এতে কী তিনি খুশি হননি? হলেতো আগের মতো দেখতে মন না চায়, অন্তত অভ্যুত্থান অপচেষ্টার নিন্দা, সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ আর হাসিনার জীবন বাঁচাতে আল্লাহপাকের কাছে শুকরিয়া আদায় করে একটা বিবৃতি দিতে পারতেন। দেশের মানুষ এবং অভ্যুত্থানের কুশীলবরা এ ব্যাপারে তার সাফ অবস্থান জানতে পারত। রাজনৈতিক সৌজন্যের পাশাপাশি দেশের ছায়া-প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, রাষ্ট্রীয় এ দায়িত্বটি খালেদা জিয়া কেন পালন করলেন না, এই প্রশ্নটিও তার কাছে।

এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান নিয়ে যত প্রতিক্রিয়া এসেছে, তাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নাম্বার ওয়ান গোলাম আযমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যকে বেশি বিপজ্জনক মনে হয়েছে। সেনা সদর দফতরকে একরকম প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে আযমী বলেছেন, সময় এলে তিনি এর জবাব দেবেন! আযমীর এই সময়টা কখন? সামনে কি তাহলে আরও ভয়ংকর কিছুর ছক আঁটা হচ্ছে? সরকার আশা করি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। আযমীকে যখন সেনাবাহিনী থেকে বিদায় করা হয়, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে প্রক্রিয়াটি ভালো লাগেনি। কিন্তু যেদিন গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হলো, এর আগে মালয়েশিয়ান টিভিতে তার ছোট ভাই নুমান আযমীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য আর উস্কানি শুনলাম, জানা গেল একটি মোল্লাপন্থী অভ্যুত্থান কুচক্রীদের ক্রিয়াকর্ম, তখন মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এই চিজ থাকতে পারে না। বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার অনিবার্য অংশ হিসাবে গোলাম আযমের গ্রেফতারের সময় আযমী যদি বহাল থাকতেন সেনাবাহিনীতে, (ওদিকে আবার মালয়েশিয়া থেকে নুমান আযমীর ওয়েব হুঙ্কার), সবমিলিয়ে তখন কি দাঁড়াত পরিস্থিতি!
 
খালেদা জিয়া গত বেশ কিছুদিন ধরে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সরকার ফেলে দেবার কথা বলেছিলেন। সেনাবাহিনী যখন নিরবে অভ্যুত্থান নস্যাতের কাজ করছিল তখন চট্টগ্রামের জনসভায় দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীতে গুম করার বিপজ্জনক অভিযোগ করেছেন বিরোধীদলের নেত্রী! এখন যদি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার বিষয়টি এভাবে জানা না যেত তাহলে বিষয়টি হয়তো আর দশটা রাজনৈতিক বাকোয়াজির মতোই থাকত। কিন্তু দেশের মানুষের যাদের একটু চোখকান খোলা রেখে চলার অভ্যাস, তারাতো জানেন, প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেত্রী অন্তত সবকিছু গায়েবি বলেন না। খালেদা জিয়ার কথাবার্তাগুলোও অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের দিন-তারিখের সঙ্গে মিলে যাওয়াতে খুব স্বাভাবিক বিষয়টিকে এখন পেয়ে বসেছে সরকারি দল! ঠিক যেভাবে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিল তত্ত্বেও বিএনপি ছেড়ে কথা বলেনি। সেই ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকার পড়ে যাবার ক্ষণগণনা জলিল সাহেব কী করে করেছিলেন, তা তাকে তখন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কথাও উঠেছিল। তখন যেহেতু সামরিক অভ্যুত্থানের কিছু ঘটেনি, তা নিয়ে এখনকার মতো টগবগে প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেনি।

 খালেদা জিয়ার আল্টিমেটামের দিকে নজর দিতে গিয়ে সরকারি লোকজন ভুলেই গেছে যে ‌ডিসেম্বর তত্ত্বটির মূল কপিরাইট কিন্তু কর্নেল(অবঃ) অলি’র। শুধু ডিসেম্বর না, ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের বিদায় আল্লাহপাক কবুল করে ফেলার ফতোয়াও দিয়েছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক বিএনপি, বর্তমান এলডিপি নেতা অলি আহমদ! অতঃপর সেনা সদর দফতরের প্রেস কনফারেন্সের তথ্যে আমরা জানলাম, মান্যিগন্যি মানুষ খালেদা জিয়া আর অলি’র মানইজ্জত অটুট রাখতে ১৩ ডিসেম্বর থেকেই অভ্যুত্থানের কাজকর্ম শুরু করে দেয়া হয়েছিল! বিএনপি নেতারা এখন এত কিছু বলছেন, এই ডিসেম্বর তত্ত্বটির শানে নজুল ছাড়া! এর জন্যে বিতর্কের বিষয়টিও তাদের পিছু ছাড়ছে না।

এখন এই অভ্যুত্থানের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় পত্রিকায় কী লেখা হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশ পক্ষেরইবা দায়দায়িত্ব কী? দুনিয়ার নানা দেশের  মিডিয়াতেইতো যার যার মতো করে অভ্যুত্থান অপচেষ্টা ভন্ডুল হবার খবর দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ব্রিটিশ ফরেন অফিস। বেশ আগে যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড মনমোহন সিং বাংলাদেশে মৌলবাদী অভ্যুত্থানের আশংকা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন, তখন আমরা তাতে গোস্বা করেছিলাম। সে নিয়ে আমাদের তুমুল আপত্তি দেখে বেচারা মনমোহনকে পরে সে বক্তব্য তার ওয়েবসাইট থেকেও তুলে দিতে হয়েছে। কিন্তু এখনতো দেখা গেল মনমোহনের গোয়েন্দা রিপোর্ট তখন ভুল ছিলো না। ভারতীয় গোয়েন্দারা অনেক আগেই তা আঁচ করে রিপোর্ট তাদের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। ভারতীয় মিডিয়ায় তারেক-জামায়াতকে ইশারা করে রিপোর্ট করাতে খুব স্বাভাবিক বিএনপি-জামায়াত বেজার হয়েছে। কিন্তু হিযবুত তাহরীরের লক্ষ্য আর ওনাদের লক্ষ্য-গন্তব্য কী আলাদা কিছু? বা ওনারা এখনও কী বলছেন, না হিযবুত তাহরীর যে ধর্মরাষ্ট্র চায় তারা এর বিরোধী? রসুনের গোড়া সম্পর্কিত অভ্যন্তরীণ ধোঁয়াশাটি পরিস্কার না করলেতো এসব আলোচনা চলতেই থাকবে।
 
এখন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সমুদয় খোলাসা হবার আগে পুরো বিষয়টি নিয়ে এখনই আগ বাড়িয়ে এতটা বলা কী সরকারি নেতাদের ঠিক হচ্ছে? বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার? অভ্যুত্থান অপচেষ্টার বিষয়টি অঙ্কুরেই ধরা পড়াতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী সহ শীর্ষ সেনাকর্মকর্তাদের জীবনরক্ষার বিষয়টিতে তাদের মধ্যে স্বস্তির সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ষড়যন্ত্র যে শেষ হয়ে গেছে সে গ্যারান্টি কে দিয়েছে? একজন প্রবাসী ব্যবসায়ী ইশরাক বিদেশ থেকে এসে কুমিল্লা আর সাভার ক্যান্টনমেন্টের একাধিক সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার পর তারা পরিকল্পনা কবুল করে ফেললেন, কুমিল্লা সেনানিবাসে গোলাগুলিও হয়ে গেল, অভ্যুত্থান নস্যাতের খবর দিতে সেনা সদরের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের পরও সংশ্লিষ্ট হিযবুত তাহরীর নামের নিষিদ্ধ সংগঠনটি আন্ডারগ্রাউন্ডে না গিয়ে নামতে গেল বাদজুম্মা মিছিলে, এসব কী কোন হেলাফেলার সংকেত?

আযমী যে এখনও হুমকি দিয়ে কথা বলছেন, এটি কী নেহায়েত কাকতালীয়? এক পলাতক মেজর জিয়াউল হককে ধরতে ক’দিন সময় লাগছে? এর মাঝে কোথায় কার নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে গেছে এই শীর্ষ বিপথগামী? এ অবস্থায় সরকার কী করে স্বস্তিবোধ করতে পারছে? আদৌ কি পারছে? এ নিয়ে সামনে আরও ঘটনা আছে। কোর্ট মার্শালে বিচারের সময়ও এই কুশীলবদের মানবাধিকার, স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের বিচারের দাবি উঠবে। অভ্যুত্থান নস্যাতের নজিরবিহীন সংবাদ সম্মেলন করে সেনাবাহিনী দেশের মানুষকে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। প্রধান দুটি দল তাদের কাজিয়ায় আবার সেখানে তুলে দিল বিভক্তির দেয়াল। এরক্ষেত্রে সরকার-সরকারি দলের ভূমিকাও কম দায়ী নয়।
 
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।