ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাবধানতাই নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধের উপায়

সফিউল আযম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১২

ঢাকা : লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিপাহ (ঘওচঅঐ) ভাইরাস দেখা দেয়।
ভাইরাসের সংক্রমণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরকারিভাবে ১৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়।

এ বছরও জয়পুরহাট ও রাজশাহীতে মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বাদুড়ের মাধ্যমে ছড়ানো এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে এনকেফালাইটিস (মস্তিষ্কের প্রদাহ) নামক রোগ সৃষ্টি করে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। কারণ, এই সময় খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। বাদুড় গাছে বাঁধা হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা মিশে যায়। সেই রস খেলে মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ ভাইরাস। এছাড়া বাদুড়ের আধ-খাওয়া ফল এবং আক্রান্ত মানুষ থেকে মানুষেও ছড়াতে পারে।

হাতীবান্ধা বাসস্ট্যান্ড এলাকার স্কুলশিক্ষক অশোক ঘোষ তাঁর দু’সন্তান অরণ্য (৯) ও অনন্যাকে (৬) হারান। খেজুরের রস খাওয়ার কারণে হঠাৎ সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় তারা। মাত্র একদিনের ব্যবধানে নিপাহ ভাইরাসের কারণে মৃত্যু হয়েছিল ওই দু’টি শিশুর। একইভাবে উপজেলার দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের বাসিন্দা কাজী জাহাঙ্গীরের দু’সন্তান জয়ী (৫) ও সর্বো (৩) পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় একই রোগে। মৃত্যুর এই সারিতে হাতীবান্ধা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তি রানী সরকারের সন্তানও রয়েছে।

‘সৌভাগ্যবশত’ সেই সময় হাতীবান্ধায় অবস্থান করি এবং আক্রান্ত রোগী, তাদের পরিবার এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়।

গত ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় হাতীবান্ধায় বাদুড়ের আধিক্য ও নিপাহ ভাইরাসের আশঙ্কা শিরোনামে খবর প্রকাশিত হলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়। এলাকাটির পরিস্থিতি জানতে হাতীবান্ধার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথে কথা বলি। সাধারণ মানুষ এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শীতকালীন শাকসবজি খেতে ভয় পাচ্ছেন। জানা যায়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘প্ল্যান বাংলাদেশ’ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচির পাশাপাশি স্বাস্থ্যবার্তা নামক ১০ হাজার লিফলেট ইতোমধ্যে বিলি করেছে। বেসরকারিভাবে কিছু কর্মতৎপরতা দেখা গেলেও সরকারিভাবে তেমন উদ্যোগ লক্ষণীয় নয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে যেভাবে আতঙ্ক বিরাজ করছে তাতে ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, পথনাটক, উঠোন বৈঠকসহ নানামুখী পদক্ষেপ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এবং আইডিডিআরবিসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এলাকাবাসী ।

সব ছোঁয়াচে রোগের মতই নিপাহ এনকেফালাইটিসও সচেতনতার মাধ্যমে অনেকখানিই প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেহেতু বাদুড়ই এ ভাইরাস ছড়ানোর প্রধানতম মাধ্যম হিসেবে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত, তাই বাদুড় থেকে মানুষকে দূরে থাকার জন্য সচেতন হওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া পরিহার করা উচিত। বাদুড় যাতে খেজুরের রস খেতে না পারে সেজন্য হাঁড়ির মুখ এবং রস বের হবার জায়গা পুরোটা বাঁশের খাঁচা কিংবা কাপড় দিয়ে ঢাকতে হবে। শিশুদের পোষা প্রাণীদের (বিড়াল, কবুতর, কুকুর ইত্যাদি) কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে। যেকোনো ধরনের ফল ভালোভাবে ধুয়ে (সম্ভব হলে গরম পানিতে) খেতে হবে, শাকসবজিও ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যেকোনো পাখি বা বাদুড় বা কাকের খাওয়া ফল (বড়ই, কলা, পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদি) খাওয়া পরিহার করতে হবে।

নিপাহ ভাইরাসের প্রাথমিক লক্ষণ হল- জ্বর, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, দুর্বলতা, বমিভাব, গলাব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। তবে রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে জীবাণু কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। তখন তীব্র জ্বরের সঙ্গে রোগী অচেতন হয়ে পড়ে, খিচুনি হয়, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে এবং আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান এবং পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। এই রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্তদের পরিচর্যা করতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগীর যত্ন নেবার সময় পরিচর্যাকারীর নাক, মুখ ঢেকে রাখতে হবে। সবসময় চামচ দিয়ে রোগীকে খাওয়ানো প্রয়োজন। রোগী যে প্লেট, চামচ বা বাটি, বালিশ, কাঁথা, জামা-কাপড় ব্যবহার করবে আলাদা রাখা এবং সেগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ কাপড় বা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখা প্রয়োজন। রোগীর কফ ও থুতু যেখানে সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগীর সঙ্গে একই পাত্র খাওয়া বা একই বিছানায় ঘুমানো যাবে না। রোগীর শুশ্রূষা করার সময় মুখে কাপড়ের মাস্ক পরে নিতে হবে।

এখন শীতকাল। শীতের সময় বাদুড়ের আনাগোনা বেড়ে যায়। নিপাহ ভাইরাসটি সাধারণত বাদুড়ই বহন করে থাকে। যেহেতু এই ভাইরাসটির কোনো প্রতিষেধক নেই। তাই জনসচেতনতা তৈরিই এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ। নিপাহ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানতা অবলম্বনই নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধের প্রধানতম উপায়।

সফিউল আযম : উন্নয়নকর্মী ও কলামলেখক, ই-মেইল : m.safiulazam@yahoo.com

বাংলাদেশ সময় : ০৭২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।