ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শুভ জন্মদিন মামুন ভাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১২
শুভ জন্মদিন মামুন ভাই

আজ লিপ ইয়ারের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার প্রিয় একজন মানুষ মামুনুর রশীদের জন্মদিন। লিপ ইয়ারের ২৯ ফেব্রুয়ারি জন্ম হওয়াতে ৬৫ বছরের জীবনে তিনি জন্মদিন পালনের সুযোগ পেয়েছেন ১৬ বার।

এর জন্য মজার মানুষ মামুন ভাই এবার তার ১৬তম জন্মদিন পালনের কথা বলেছেন। আমাদের চেনাজানার জগতে আপাদমস্তক ব্যতিক্রমী বর্ণাঢ্য এক মানুষ এই মামুনুর রশীদ। একাধারে অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অগ্রপথিক সৈনিক। তোমাকে হাজার সালাম মামুন ভাই, শুভ জন্মদিনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে অজস্র শুভ কামনা।   কেমন আছে আমার প্রিয় পল্লব (মামুনুর রশীদ দম্পতির একমাত্র সন্তান), দীর্ঘ জীবনের সুখেদুঃখের সঙ্গিনী আমাদের প্রিয়তমা ভাবী? এই সুযোগে তাদেরকেও শুভেচ্ছা।

বাংলাদেশের মানুষকে মামুনুর রশীদকে আলাদা পরিচয় করিয়ে দেবার, চেনানোর প্রয়োজন নেই। চেনা ব্রাক্ষ্মণের পৈতা লাগে না। মঞ্চের বা রূপালি তারার দেশের কড়া মেকআপের ঝলমলে নায়কের মেকি ইমেজ বা পরিচিতি তার নেই ঠিক, কিন্তু মামুনুর রশীদ ভাবতেই মানুষের মানসপটে ভাসে, একজন পরিপূর্ণ অভিনেতার প্রতিচ্ছবি, যিনি সহজাতভাবে যে কোনো চরিত্রের গভীরে চলে গিয়ে মানুষের মনকে নাড়া দিতে জানেন-পারেন। সে কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে একদল মেধাবী কর্মী-সংগঠকের গড়া নাট্য আন্দোলনে মামুনুর রশীদ তাই অনিবার্য এক নাম। ওরা কদম আলী, ইবলিশ, ওরা আছে বলেই, এখানে নোঙর, গিনিপিগ, সংক্রান্তি, রাঢ়াং, জয়জয়ন্তী, চে’র সাইকেলসহ আরও স্মরণীয় নাটকের সংগঠনে, অভিনয়ে মামুন ভাইয়ের সৃষ্টি তাকে অনিবার্য, বিশিষ্টজনে পরিণত করেছে। মামুনুর রশীদ না ভেবে তাকে কদম আলীই ভাবা যায়। তিনি কবিতা লিখেন সংলাপে, সেই সংলাপ বলতে বলতে তিনি সৃষ্টি করেন সেই চরিত্রের, যে চরিত্রগুলোর সক্রিয়তায় সমাজবদলের স্বপ্ন দেখেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। যেখানে থাকবে না রাষ্ট্রের ধর্ম নামের আলাদা ভণ্ডামির অবশেষ। রাষ্ট্র হবে সব ধর্ম বর্ণের মানুষের কাছে সমান। মানুষের সম্মান-অধিকার যেখানে থাকবে সবার শীর্ষে। যে যার কথা স্বাধীনভাবে বলতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের, বাংলাদেশের পক্ষে থাকলে জনসমক্ষে স্বাধীন কথা বলা যায়। বিপক্ষে থাকলে বা গোপনে নুন খেলে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে হয়। মামুনুর রশীদ চরিত্র এই ভণ্ডামি মুক্ত।

লেখালেখির সূত্রে মামুন ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শেষের দিকে শান্তিনগর থেকে বেরুতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নের পত্রিকা ‘নয়া পদধ্বনি’। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের অন্যতম লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান সম্পাদিত সে পত্রিকায় ড. আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিনোদ দাশগুপ্ত, আবদুল মতিন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, শাহরিয়ার কবীর, মামুনুর রশীদসহ আরো অনেকে লিখতেন। কাজী নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবীর নেতৃ্ত্বাধীন সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেন্দ্র থেকেই তখন সেই সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘একাত্তরের দালালরা কে কোথায়’ বেরোয়। আজকের দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নানান কিসিমের পাইওনিয়ার দাবিদার সৃষ্টি হলেও মূলত সেই চেতনা বিকাশ কেন্দ্র আর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দালালরা কে কোথায়’কে কেন্দ্র করেই এই বিচার দাবির নিউক্লিয়াসটির সৃষ্টি হয়। ড. আহমদ শরীফসহ সেই ‘নয়া পদধ্বনি’ পরিবারের সব সদস্যের স্বপ্ন ছিল সমাজতান্দ্রিক বাংলাদেশ গড়ার। সে স্বপ্নে মিশনারিদের মতো তারা নয়া পদধ্বনিতে লেখার সম্মানির ৩শ টাকার দেড়শ টাকা নিতেন। বাকি দেড়শ টাকা পত্রিকার তহবিলে দান করতেন। শান্তিনগর মোড়ের পুরনো ভবনটিতে তখন লিফট ছিল না। সিঁড়ি ভেঙে ৪ তলার অফিসে প্রতি সপ্তাহে একবার পত্রিকার মিটিংয়ে সবাই আসতেন। তাদের যার যার লেখা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি রিপোর্টিং আইডিয়া বাস্তবায়নের অ্যাসাইনমেন্ট তাদের টিমের টি-বয় তুল্য সবচেয়ে জুনিয়র সদস্য হিসেবে দিতেন আমাকে। সেই সুযোগে বিশাল মাপের এসব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, অনেক স্মরণীয় রিপোর্ট করার সুযোগ হয়।

মামুনুর রশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি পারিবারিক পর্যায়ে গড়ায়। নানা প্রয়োজনে অথবা আড্ডা দিতে চলে যেতাম তার তখনকার কলাবাগানের বাসায়। ভাবী, পল্লবের সঙ্গে সখ্য তখন থেকে। অনেকদিন মামুন ভাই তার বৈকালিক হাঁটাহাঁটিতে সঙ্গে নিতেন। কথায় কথায় বলতেন তার জীবনসংগ্রামের নানা ঘটনা। দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক নানা বিষয়ে তার বিশ্লেষণ, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, কষ্টের কথাগুলো বলতেন। জীবনের চলার পথে এসব অনেক কাজে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। তার অনেক বিশ্লেষণ নানান লেখালেখিতেও কাজে লাগিয়েছি। ‘নয়া পদধ্বনি’ বন্ধ হয়ে যাবার পরও অটুট ছিল সে সম্পর্ক। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মিছিলে-সংগ্রামে, পরবর্তীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃ্ত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলনে রাজপথে অনেক দেখাদেখিতে সে সম্পর্ক অনেক প্রগাঢ় হয়। সেই মামুনুর রশীদ এখনও আছেন সেই সংগ্রামের প্রথম কাতারে। নিরপেক্ষতার নামাবলী গায়ে দিয়ে আমাদের অনেক শিল্পী অথবা সাংস্কৃতিক বোদ্ধা-ব্যক্তিত্ব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে সক্রিয় জড়াতে চান না। আসলে এর মাধ্যমে অসচেতন অথবা সচেতনভাবে এরা যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির তাবেদারি করেন। আড়ালে আবডালে তাদের সুযোগ সুবিধাও নেই। এসব ভণ্ডামিমুক্ত মামুনুর রশীদ। সোজাসাপ্টা দেশের মানুষের পক্ষে, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে। এর জন্যে তাকে ভালোবাসি, মন থেকে শ্রদ্ধা করি। বাংলাদেশকে ভালোবাসেন মামুন ভাই। বাংলাদেশের মানুষও তাকে অন্তর থেকে ভালোবাসে। সর্বশেষ তাকে একুশে পদকের মাধ্যমে এর স্বীকৃতি দিয়েছে রাষ্ট্র। দেশে আজকাল প্রায় প্রিয় মানুষগুলো মরে যাচ্ছে। আপনি অনেকদিন বাঁচুন প্রিয় মামুন ভাই। সাবধানে থাকবেন। মেডিকেল চেকআপ নিয়মিত করাবেন। আর হাঁটবেন নিয়মিত। প্রিয় পল্লব, ভাবীকে আবারও শুভেচ্ছা। আপনাদের সবাইকে খুব মিস করি মামুন ভাই।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক     

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।