ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

হায়, আমাকে বাঁচাতে কেউ ছিল না!

রাজীব নন্দী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১১ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১২
হায়, আমাকে বাঁচাতে কেউ ছিল না!

সম্প্রতি চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। দেখি শিক্ষার্থীশূন্য প্রিয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খাঁ খাঁ রোদে পুড়ছে।

ঝুপড়ি এখন মুখরিত থাকার কথা তরুণ বুদ্ধিজীবীদের আড্ডায়। অথচ অলস ক্যাম্পাসে কিছু ভবন কেবল দাঁড়িয়ে আছে! গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংঘাতময় পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ হয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থীরা হল ছেড়েছেন। কথা আছে ১৭ মার্চ থেকেই ক্যাম্পাস আবারো সচল হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং আড়াই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলে এই হত্যাযজ্ঞ এবং পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাস অচল করার ঘটনা অন্য দশজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের মতো আমাকেও বিচলিত করেছে।

হিটলার যখন তার শক্তির সবটুকু দিয়ে বিরোধী মতাদর্শী/দলীয়কর্মীদের ধরে ধরে কতল করছিল তখন নাকি জার্মানির বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ ছিল একেবারেই নীরব ও মূক। সেই নীরবতা সেদিন ফ্যাসিবাদ কায়েমের পথ প্রশস্ত করেছিল। জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট নাৎসি শক্তির উত্থানের সময়কার এক কবির উচ্চারণকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুনভাবে লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে-

ওরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিভাগীয় সভাপতিকে
ঝর্ণার পাড়ে দিনে দুপুরে কোপালো
আমি কোনো কথা বলিনি -
কারণ আমি তো শিক্ষক নই... বিভাগীয় সভাপতি নই।
একদিন ওরা যখন ছাত্রীহলের সামনে দাঁড়িয়ে বখাটেপনা করছিল
আমি কোনো কথা বলিনি -
কারণ আমি তো আবাসিক হলের ছাত্রী নই।
ওরা যখন এক সাংবাদিককে শাটল ট্রেনে হুমকি দিল
আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম-
কারণ আমি তো সাংবাদিক না।
শেষে ওরা যখন আমাকে ধরতে এল
তখন আমার হয়ে কথা বলার কাউকে পাইনি,
হায়, চবি ক্যাম্পাসে আমাকে বাঁচানোর জন্য কেউ ছিল না।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি হত্যাযজ্ঞের অনুপুঙ্খ তদন্ত অবশ্যই জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ কমিটি সকল ছাত্র সংগঠনের সাথে বৈঠক সম্পন্ন করেছে। বর্তমান লিয়াজোঁ কমিটি সকল ছাত্র সংগঠনের সাথে এক টেবিলে বসে আলোচনা চালিয়ে নিয়ে গেছেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি ইতিবাচক দিক। এর জন্য উপাচার্যের আন্তরিকতা ও প্রশাসনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এক্ষেত্রে ছাত্র-উপদেষ্টা ড. খান তৌহিদ ওসমান ও শিক্ষক সমিতি সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য।   একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এর আগে দেখেছি তদন্তের ফল প্রকাশের পূর্বে পারস্পরিক হিংসার কার্যকারণসূত্র সম্পর্কে এবং ঘটনা ঘটবার অব্যবহিত পরেই মন্তব্য এবং সিদ্ধান্তের প্লাবন বয়ে গেছে। আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করার পুরনো বদভ্যাসটি অবাঞ্ছিত রক্তপাত ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যকার সংঘাতকে আরো উসকে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রশাসন ডান-বাম সকল ছাত্রসংগঠনকে ডেকেছে। করণীয় নির্ধারণে সবার মতামত জানতে চেয়েছে। ক্যাম্পাস অচলাবস্থার মধ্যে প্রশাসনের এই উদ্যোগ প্রকৃত অভিভাবকসুলভ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর প্রতিনিধি হিসেবে সিন্ডিকেট সদস্য সাবেক ভিসি অধ্যাপক আবদুল মান্নান সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছেন, `গত তিন বছরে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো সংঘাত হয়নি। কোনো কোনো সময় ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাও নিয়েছে। ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে, কিন্তু দুটি সংগঠনের মধ্যে এ রকম রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়নি। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নেওয়ার পর গত সাত মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা যথাসময়ে নির্বিঘ্নে হয়েছে, অন্যান্য কর্মকাণ্ডও(কার্যক্রমও) সুষ্ঠুভাবে চলেছে। `

এটি শুধু অধ্যাপক মান্নানের ভাবনাই নয়, আমরা যারা ক্যাম্পাসের খবরাখবর নিয়মিত রাখি তারাও জানি। বর্তমান উপচার্য দায়িত্ব গ্রহণের পর দৃশ্যত ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহের উৎপাত হ্রাস পেয়েছিল। গত নয় মাস আগে কোন বিভাগে সবচেয়ে বেশি সেশনজট- এরকম সংবাদ সংগ্রহের আশায় আমরা যখন অনুসন্ধান করছি তখন দেখেছি কম্পিউটার সায়েন্সেস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ একাধিক বিভাগ সেশনজটমুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছে। এক সময়কার ধর্মান্ধ ক্যাম্পাসে যখন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরদের নামও উচ্চারণ করা যেত না সেই ক্যাম্পাসে এখন প্রশাসনের উদ্যোগে মাস্টারদা সূর্যসেনের ৭৮তম ফাঁসি দিবস মহাসমারোহে পালিত হয়েছে। হালদা নদীর গবেষণায় দক্ষিণ এশিয়ার গৌরবময় পুরস্কার, বিরল প্রজাতির অর্কিড ও বন্য প্রাণী (নতুন প্রজাতির ব্যাঙ) গবেষণা এবং কম্পিউটার সায়েন্সেসে আন্তজর্তিক স্বীকৃতির ঘটনা সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে।   হামলা-সংঘর্ষ-দুর্নীতির বিপরীতে এসব ‘সুখবর’ সংবাদ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এতসব সুখবরকে ম্লান করে দেয়ার জন্য দুই ছাত্র সংগঠনের লড়াই-ই তো যথেষ্ট!

অধ্যাপক আবদুল মান্নান একটি জাতীয় দৈনিকে বলেন,‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে সব মহলের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন মহল থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খণ্ডিত প্রতিবেদন পেয়েছে, যা দিয়ে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তবে দু-একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের একাধিক নেতা-কর্মীকে ক্যাম্পাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনও ছিল খণ্ডিত, যে কারণে ঘটনার খলনায়কেরা পার পেয়ে যায়। আর প্রতিবেদনে সিনেটে নির্বাচিত একজন উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এতে ক্যাম্পাসে অশান্তির সৃষ্টি হয়। ’

কিন্তু এই ভয়াবহ ঘটনা কি অপ্রত্যাশিত? অহেতুক? আকস্মিক? গত কয়েক দশক ধরে ক্যাম্পাসের সর্বত্র,বিশেষত পাহাড় ঘেরা আবাসিক হলসমূহে নাশকতার যে পরিকল্পিত প্রস্তুতির ঘটনা ঘটেছে, যে-ভাবে প্রতিটি ফ্যাকল্টিতে চিহ্নিত দুষ্কৃতকারীরা বসত গেড়েছে, তাই কি এ ধরনের ঘটনার মূল নয়? গত আট বছর প্রত্যক্ষদর্শীর আসনে ক্যাম্পাসবাসী ও গণমাধ্যম এ জিনিস প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৯৯ থেকে ২০১১। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই একযুগে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনায় দা-কিরিচ,লাঠি-সোঁটা ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়নি বললেই চলে। কিন্তু ২০১২ এ এসে শুরু হলো আবার সংঘাত। ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুই ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আবার গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। আবার রক্ত ঝরল। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়। দীর্ঘ বিরতির পর সাম্প্রতিক  সময়ে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে  ভাবিয়ে তুলেছে। প্রায় ভুলতে বসা সশস্ত্র সংঘাত আবার ফিরে এসেছে।
যাদের হত্যা করা হচ্ছে, যিনি ছিনতাই হলেন, যে আহত হলো, যে নির্যাতিত হলো - সে তো আমি নই! এই ‘আমি নই’ আত্মতুষ্টিই আঠারো হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে ভয়ের সংস্কৃতির নতুন নতুন মাত্র যোগ করে। যে ভয়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে ঘনিয়ে আসে নিরবতা;আর নিরবতার জলে-মাটিতে বেড়ে উঠে সন্ত্রাসের বীজ।

ক্যাম্পাস সচল রাখার বৃহত্তর বিবেচনায় মাননীয় উপাচার্য সহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কিছু বিনীত প্রস্তাব রাখছি-
১. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি ও সকল রাজনৈতিক হামলার পর বাহিনির তৎপরতা নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
২. মেধার ভিত্তিতে আবাসিক হলে সিট বণ্ঠন।
৩. সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে প্রশাসনিক উৎসাহ।
৪. ছাত্র-উপদেষ্টার নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাউন্সেলিং প্রদান কার্যক্রম।
৫. মৌলবাদ ও অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিনিধিত্বহীন স্থায়ী পরিবেশ পরিষদ গঠন।
৬. প্রক্টরিয়াল বডির জনবল বৃদ্ধি ও ছাত্রাধিকারের ব্যাপারে আন্তরিক শিক্ষকদের কমিটিতে অন্তভুর্ক্ত করা।
৭. বিজ্ঞান ও গবেষণাখাতে বরাদ্দ বাড়ানো।
৮. ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্রসংগঠনের মূল দলের সাথে নিয়মিত সংলাপের আয়োজন
৯. গত ৮ ফেব্রুয়ারি সংঘাতে যারা যুক্ত স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি করা।
১০. তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দ্রুত প্রকাশ।

রাজীব নন্দী, সাংবাদিক ও ব্লগার
rajib1nandy@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।