ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মহাসমাবেশের মহাশান্তি!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১২
মহাসমাবেশের মহাশান্তি!

মহাসমাবেশকে ঘিরে কোনো অশান্তি ঘটেনি। ভালোয় ভালোয় মহাসমাবেশটি হয়ে যাওয়ায় অবশেষে স্বস্তি এসেছে দেশবাসীর মনে।

এর জন্যে উদ্যোক্তা বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কৃতজ্ঞতা। আদতে প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো অশান্তি চায়নি। তারা ভালো একটি জনসমাবেশ করতে চেয়েছে এবং তারা তা করেছেও। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরকে কেন্দ্র করে সরকারে উদ্বেগ ছিল। এই উদ্বেগ অমূলক নয়। কিন্তু বিএনপি তাদের ভালো একটি কর্মসূচির স্বার্থে তাদেরও নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক ভূমিকার কারণে হিযবুত তাহরীর বা অন্য কারও কিছু করে পার পেয়ে যাওয়া সহজ ছিল না।
 
কিন্তু সরকারি দলও যে প্রতিপক্ষের ভালো একটি জনসমাবেশ চায়নি সেটিও সত্য। এটি ব্যাহত করতে তারা যা করেছে, তা নিন্দনীয়। সারাদেশের স্বাভাবিক যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি, ঢাকার খাবার হোটেল বন্ধসহ বাড়াবাড়ির নানা কিছুকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের যে ভোগান্তি ঘটানো হয়েছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। আশ্চর্য এখন পর্যন্ত এসব ভোগান্তির জন্যে সরকারি দলের কোনো নেতা জনগণের কাছে ‘দুঃখিত’ পর্যন্ত বলেননি। এই একটি মহাসমাবেশকে সফল অথবা ব্যর্থ করতে দু’পক্ষের ঠেলাঠেলির ভোগান্তিতে যে পাবলিকের হিসাবের পয়সা থেকে বাড়তি খরচ হয়েছে, এর দায়দায়িত্ব কার? স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ভোগান্তির জন্য বিএনপি দায়ী! ক্ষমতায় আপনি আর জনগণের ভোগান্তি করে বিএনপি! তাহলে এতো অযোগ্য-অপদার্থ আপনি ক্ষমতায় বসে আছেন কেন?
 
এর আগে একটি লেখায় অনুরোধ করে লিখেছিলাম, পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রাখতে প্রশাসনকে কাজে লাগান, কিন্তু দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করবেন না। নীতিনির্ধারকরা তা শোনেননি। ছাত্রলীগ নামধারী যে গুণ্ডাদের লাঠিয়ালের মতো ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের গুণ্ডামির যেসব ছবি ছাপা হয়েছে মিডিয়ায়, এতে সরকারি দলের ইমেজ আরো ক্ষুণ্ন হয়েছে। এদের সঙ্গে সদরঘাটে লাল ড্রেস পরা কথিত নৌ-শ্রমিক গুণ্ডাদের তফাৎ কি? দেশের মানুষ কিন্তু এসব গুণ্ডামি পছন্দ করে না। তা যে দলেরই হোক না কেন। পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডারা প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কর্মীদের পিটিয়েছে। পুলিশ কিছু করেনি। এসব নৈরাজ্য আইনের শাসনের কলঙ্ক। এমনিতে ছাত্রলীগ নামধারীদের গুণ্ডামি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকারি দল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা নিজেদের ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। দেশের নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এদের নৈরাজ্যের কাছে জিম্মি। সর্বশেষ মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তাদের যেভাবে ব্যবহার করা হলো, এতে করে এদের নৈরাজ্যের দাপট নতুন করে ছড়িয়ে যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী সর্বক্ষণ মহাসমাবেশের খোঁজখবর রেখেছেন, লোকসমাগম সম্পর্কে বলেছেন, তাদের (বিএনপির) প্রস্তুতি ভালো ছিল, এসব ইতিবাচক। আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফ বললেন কি? হানিফ সাহেব বললেন, তাদের ‘মহাসমাবেশে জনসমাগম কম হওয়ায় এবং মানুষ আনতে ব্যর্থ হওয়ায় বিরোধীদলের নেতা বেসামাল হয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন’! আপনারা দেশের সবকিছু বন্ধ করে দিলেন, আর বলছেন লোকসমাগম কম হবার কথা! এসব কথাবার্তায় কিন্তু দেশের মানুষ হাসে। মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে গেলে পরবর্তীতে ভোটের বাক্সে এর প্রভাব পড়ে।

আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হিসেবে হানিফ সাহেবদের এসব বোঝার কথা। আর ঢাকা শহরে যত লোক আছে, তাদের এক দশমাংশও যদি কোনো সমাবেশে যোগ দেয়, তাহলে কিন্তু আর বাইরে থেকে লোক আনা লাগে না। বলতে পারতেন ঢাকা শহরের কত পার্সেন্ট লোক যোগ দিয়েছে এই সমাবেশে। আসলে বড় দু’ রাজনৈতিক দলের কামড়াকামড়িতে মানুষ এত বেশি ত্যক্তবিরক্ত যে বেশিরভাগ মানুষ এদের কারও সমাবেশেই যায় না। দু’দলই সমাবেশে লোক দেখাতে বস্তি থেকে লোকজন ভাড়া করে নিয়ে যায়। জামায়াতের অবশ্য চাকুরে নেতাকর্মীদের সমাবেশে বাধ্যতামূলক যেতে হয়। বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারি দল এত বেশি বেদিশা ভাব দেখিয়েছে যে এতে অনেক লোকের আগ্রহ হয়েছে। সে কারণে পুলিশের ঠিক করে দেওয়া সীমানার বাইরে ছড়িয়েছে সমাবেশ। যৌক্তিক বাস্তবতায় শুভ বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে পুলিশও তখন আর বাধা দিতে যায়নি। ব্যারিকেড সরিয়ে নিয়েছে নিজেরাই। এরশাদ আমলেও দেখেছি, কোনো কর্মসূচিতে লোক সমাগমের আকার দেখে পুলিশি অ্যাকশন নির্ভর করে। লোক সমাগম বেশি দেখলে সতর্ক পুলিশও পিছু হটে যায়। মাইরের ডর সবারই আছে।
 
মহাসমাবেশের লাইভ টেলিকাস্টে বাধার বিষয়টিও চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক হয়েছে। বিটিআরসির আইনে এমন বাধার বিষয়টি আছে। কিন্তু তা আপত্তিকর, অবাধ তথ্যপ্রবাহ, মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থি। কারণ, সরকার এসব টিভি চ্যানেলকে অনুমোদন দিয়েছে। শুরুতে বিটিআরসি জনস্বার্থে লাইভ প্রচার না করতে বলে। কিন্তু এর রেজাল্ট খারাপ হবে বলে পরে কৌশল পাল্টানো হয়। ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমে বন্ধ রাখা হয় বাংলাভিশন আর একুশে টিভির সম্প্রচার! ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে গেলে এর ভিকটিম হতে পারে। বাংলাভিশন বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের চ্যানেল। একুশে টিভি খালেদা জিয়ার সংসার কোর্ট কাজে লাগিয়ে কী রকম হিংস্রতার সঙ্গে বন্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিক সাইমন ড্রিংকে কিভাবে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তা আমরা ভুলে যাইনি। এরপর বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের কর্তৃত্বে যায় একুশে টেলিভিশন। এসব টিভি বিএনপিকে সার্ভিস দিতে চাইবে, এটিতো খুবই স্বাভাবিক। অথবা এসব কোনো চ্যানেল বা মিডিয়াতো রামকৃষ্ণ মিশন না। সবাই টিকে থাকার নামে যার যার ব্যবসা দেখে।

শর্ত সাপেক্ষে ডিএমপি যে মহাসমাবেশের অনুমতি দিয়েছে, এটি বাংলাদেশে অস্বাভাবিক মনে হলেও উন্নত দেশগুলোয় এটিই নিয়ম। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও কোনো সমাবেশের আয়োজন করতে গেলে সমাবেশে কী ধরনের ব্যানার ব্যবহার করা হবে তার বিবরণ এমনকি ব্যানার-প্ল্যাকার্ডের ভাষাও আগেভাগে পুলিশকে জমা দিতে হয়। এসব দেশে একজনের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে আরেকজনের অধিকার যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, তা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় সমাবেশের স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণ, সমাবেশকে কেন্দ্র করে যাতে অন্যদের চলাচল বা স্বাভাবিক জীবনে যাতে বিঘ্ন না ঘটে। সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় পুলিশ স্বল্পতার কথা বলে বিএনপি-জামায়াতকে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পার্থে অনুমতি না পেয়ে সে শহর থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা ফ্লাইটের দূরের শহর সিডনির হাইডপার্কে নির্ধারিত সময়ের জন্য বিক্ষোভ করলেও বিক্ষোভকারীদের হাইড পার্কের বাইরে রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি। কারণ সমাবেশ রাস্তায় নামলে যে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটবে, তা এদেশে অস্বাভাবিক।

এমনিতে কোনো উৎসব উপলক্ষে এদেশে বিশেষ কোনো রাস্তা বা স্টেশন বন্ধ রাখলেও তা অনেক আগে থেকে প্রচার করা হয়। এ দেশের রাস্তাঘাট এত বেশি যে এমন এক-দু’টি সড়ক বন্ধ রাখলে তাতে সারা শহরের জনজীবনে প্রভাব সৃষ্টি করে না।

উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়ায় কখনো প্রকাশ্য স্থানে রাজনৈতিক সভাসমাবেশও হয় না। কারও সমাবেশ করতে চাইলে তা ভাড়া করা হলরুমের মধ্যে করতে হয়। এদেশের ধর্মীয় কোনো সমাবেশেও মাইক ব্যবহারের অনুমতি নেই। সে কারণে অস্ট্রেলিয়ার কোনো মসজিদে কখনো মাইকে আজানও হয় না। আজান-নামাজ সবকিছুতেই মসজিদের ভিতরে নিয়ন্ত্রিত শব্দের সাউন্ডবক্স ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে কিন্তু সভাসমাবেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে আরেকজনের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন, স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। কোনো একটি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে একবার যে যানজটের সৃষ্টি করা হয়, তার রেশ চলে দীর্ঘ সময়। সব রাজনৈতিক দল বসে এসব বন্ধ করা দরকার। মহাসমাবেশের কর্মসূচি, রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে লিখবো আরেকটি লেখায়।
 
লেখক: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ১০০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।