ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পার্বত্য দর্শন: পর্বতারোহণ, পর্যটন ও পরিবেশ সচেতনতা

রোবায়েত ফেরদৌস, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১২
পার্বত্য দর্শন: পর্বতারোহণ, পর্যটন ও পরিবেশ সচেতনতা

ROBAETরোবায়েত ফেরদৌস [এ সময়ের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও বক্তাদের একজন। সমসাময়িক বিষয়াবলিতে তার তথ্যনির্ভর লেখনী ও যুক্তিনির্ভর বচন-বাচন বিভিন্ন মহলেই পঠিত, শ্রুত ও প্রশংসিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই তরুণ শিক্ষক বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য লিখেছেন ...

পার্বত্য দর্শন: পর্বতারোহন, পর্যটন ও পরিবেশ সচেতনতা

" Climbing Everest now is no longer the big challenge it was, but just a walkway with ladders and fixed ropes all along the route ..."      - Hillary (1919-2008)

পিচ্ছিল পাথুরে পাহাড় বেয়ে যতই উপরে উঠি, মনে হয় প্রকৃতির বিশালতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করছি। প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের এখানেই বড় পার্থক্য। পশ্চিম মনে করে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা মানে পাহাড়কে জয় করা; পর্বতে ওঠা মানে পায়ের নিচে ফেলে পাহাড়জয়ের দাম্ভিকতা প্রকাশ করা। বিপরীতে ভারতীয় দার্শনিকতায় পাহাড়ে ওঠা মানে জয় নয়, সমর্পণ---প্রকৃতির কাছে,  মুগ্ধতার কাছে মাথা নোয়ানো; জয় আসলে পরাজয়; কার কাছে? সৌন্দর্য্যমানসের অতৃপ্তির কাছে। কেওক্রাডংয়ে উঠে আদিবাসী পাহাড়ি মানুষদের কাছে আমি এ দীক্ষা নিয়েই ফিরে এসেছি যে, ওটা আসলে জয় নয়, হয় পরাজয় নয়তো সমর্পণ।

আকাশ কত উপরে? কেউ তা জানে না; শূন্যতার পরে কেবলই শূন্যতা। কিন্তু আকাশকে ছুঁয়ে আছে যে পাহাড় তার শীর্ষবিন্দু ছুঁতে পারাটাও কম কথা নয়। বড় দিনের ছুটিতে আমরা ক`জন সেই আকাশ ছোঁয়ার নেশায় ছুটে গেলাম পাবর্ত্য জেলা বান্দরবানে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডংয়ের শিখর ছোঁব।

কেওক্রাডংয়ে যাওয়ার পথে মাটি থেকে ২৭০০ ফুট উঁচুতে বগালেকে থামতে হয়। পাহাড়ের মাথায় এটি অসাধারণ এক প্রাকৃতিক লেক। আশ্চর্য সুন্দর! বগালেক দেখে মনে হতে পারে এটি মৃত কোনো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। সত্যি বলতে কি এটি আমাকে ২০১০-এ দেখা ইতালির পম্পেই নগরীর ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির সুপ্ত জ্বালামুখের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। মনে হবে হাজার বছর আগে কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত শেষে এ যেন এক ক্লান্ত জ্বালামুখ। রাগ-ক্ষোভের সব গলিত লাভা বের করে দিয়ে দুঃখী হৃদয়ের অশ্রুপাত দিয়ে ভরে রেখেছে এই লেকের টলটলে জল। স্থানীয় বম জনগোষ্ঠীর মানুষদের কাছে এই লেক তৈরির অসাধারণ মিথ শোনা যায়- প্রজন্ম পরম্পরায় যা বয়ে চলেছে। অজগরের সঙ্গে বম মেয়ের হৃদয় দেওয়া-নেওয়ার কষ্টমাখা এক মিথ। কিন্তু মিথে পা রাখার আগে ভ্রমণপিপাসুদের মোকাবিলা করতে হবে নিরেট বাস্তবতা। বগালেকে যেতে প্রথম দফায় রুমা বাজারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, দ্বিতীয় দফায় পুলিশের কাছে এবং তৃতীয় দফায় লেকে ওঠার আগে আবারও সেনাক্যাম্পে নাম নিবন্ধন আর বদন দর্শন করাতে হয়। নিরাপত্তার কারণে করা হলেও বিষয়টি বিরক্তিকর। কেন এসব ঝামেলা পার হয়ে যেতে হবে- একজন পর্যটকের পক্ষে নিরাপত্তার এই রাজনীতি বোঝা মুস্কিল বৈকি। আর বাড়তি যে বিষয় তাহলো রুমা থেকে বাধ্যতামূলকভাবে একজন গাইড নিতে হবে; যদিও গাইড সঙ্গে নেওয়ার ভালো-মন্দ দুই-ই আছে।

বগালেকের পাড়েই সাদামাটা থাকার ব্যবস্থা। লেকের স্নিগ্ধ-গভীর জলে স্নান সরা যায়, এর পানি কখনই শুকায় না; পানির গড় গভীরতা ১৭৫ ফুটের মতো। জনশ্রুতি আছে লেকের জল পরিব্রাজকের মানসিক কষ্ট আর শারীরিক ক্লান্তি নিমেষেই দূর করে দ্রুত ফুরফুরে মেজাজ উপহার দেয়! প্রতি জনে প্রতি রাতের জন্য একশ টাকা দিলে আয়েশ করে ঢালা বিছানায় ঘুমানো যাবে। সস্তায় সুস্বাদু কলা আর পেঁপে পাওয়া যায়। বগালেক ধরে জঙ্গলের দিকে একটু এগোতেই দেখি বাংলাদেশি রাজনীতির ‘স্ট্যান্ট’ আর ‘গিমিক’ এর নমুনা; বাংলাদেশের তথাকথিত উন্নয়নের হাইব্রিড ভিত্তিপ্রস্তর। নাকি একে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বিজ্ঞাপন-ফলক বলাই শ্রেয়? বগালেকে সাংসদ বীর বাহাদুর পর্যটন মোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন, ভিত্তি কবে প্রস্তর হয়ে গেছে কিন্তু মাটি ফুঁড়ে মোটেলের চারাগাছ এখনও  উঁকি দেয়নি। কবে দেবে কে জানে! লেকপাড়ের অধিবাসীরা সহজ সরল জীবন যাপন করে। স্থানীয় অধিবাসীদের বেশির ভাগই খৃস্টানদের ইভানজেলিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ। আছে বাঁশ-টিন দিয়ে তৈরি তাদের গীর্জা ঘর। এদের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে; বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত পথে বমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, মারমা আর ত্রিপুরাদের গ্রামেরও দেখা মিলবে। চোখে পড়বে কিছু পাড়া রিসোর্স সেন্টার, ইউনিসেফ আর অ্যাকশন এইডের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে। সামাজিক বিষয়াদি, বিচার-শালিসসহ নানাবিধ কাজে পাড়ার মানুষরা এসব সেন্টার ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানে সেনাদের নজরদারিতে থাকতে হয়। আমরা বগালেকে একরাত থেকে কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছি কেওক্রাডং (৩১৭২ ফুট) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ; কিন্তু বেশ ক’বছর আগেই কেওক্রাডং তার মর্যাদা হারিয়েছে। এটি এখন তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চটি তাজিনডং ( ৩২৮৪ ফুট) আর সাফা হাফলং (৩৪৮৮ ফুট) হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। পাহাড়ের উচ্চতা মাপা হয় জিপিএস গার্মিন ডিভাইস দিয়ে, যেখানে উচ্চতার হিসেব ধরা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এবং এর হিসেব ০.২১ ফুট পর্যন্ত কম-বেশি হতে পারে।
 
দুঃখজনক যে, তাজিনডং পাহাড়ের নামকে আমরা বিজয় নাম দিয়ে ফেলেছি। আমি মনে করি পাহাড়ের নামগুলো স্থানীয় আদিবাসীরা যে ভাষায় ডাকে সেটাই হওয়া উচিত। এর উপরে বাংলা ভাষার নাম চাপিয়ে দেয়া মানে প্রান্তিক সংস্কৃতির ওপর  আধিপত্যশীল সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া, সংস্কৃতির বহুত্ববাদকে অস্বীকার করা, যা একেবারেই ঠিক না। এরই মধ্যেই পাহাড়ের বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্পট আর কৃত্রিম স্থাপনার নাম বাঙালিকরণের অপচেষ্টা আমরা করেছি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যেভাবে আমাদের উপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, পাহাড়ের ভাষার ওপর আমরা ঠিক সেই আচরণই করতে চাইছি। এটাও এক ধরনের ঔপনিবেশিক চিন্তা। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর যে বাঙালি ভাষাগত, জাতিগত আর সামরিক শাসন-শোষণের শিকার হয়েছে পাহাড়ের ক্ষেত্রে সেই বাঙালিরা একই কায়দায় ভাষাগত, জাতিগত আর সামরিক শাসন-শোষণ চালাবে না- এটাই ছিল যৌক্তিক প্রত্যাশা। কিন্তু আদিবাসীদের প্রত্যাশার সেই রুটিতে লাল পিঁপড়ে ওঠানোর চেষ্টা চলছে পাহাড়ের সর্বত্র।

পাহাড়ে মানুষ কেন ওঠে? খোলা মন নিয়ে আমি এটা বোঝার চেষ্টা করেছি। এই যে ঝুঁকি নেওয়া, এই যে কষ্ট স্বীকার করা, এর মানে তবে কি? ১৯৫৩ সালের ২৯ মে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে এগারটায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গিরিরাজ হিমালয়ের এভারেস্ট (২৯,০২৯ ফুট), স্থানীয় নেপালিদের ভাষায় সাগরমাথা, মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম জয় করেন নেপালী নাগরিক তেনজিং নোরগে শেরপা এবং নিউজিল্যান্ডার এডমন্ড হিলারি। শেরপাদের লোকায়ত একটা বিশ্বাস ছিল, সাগরমাথা কেবল শেরপারাই জয় করতে পারেন। কারণ তাদের বিবেচনায় ওটা জয় নয়, ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ আর সমর্পণের এই দার্শনিকতা কেবল শেরপারাই ধারণ করতে পারেন। এভারেস্ট জয়ের পর তেনজিং শেরপার সন্তানেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাবা, কেন তুমি এভারেস্টে উঠতে গেলে। ’ জবাবে বুক কাঁপানো উত্তর দেন তেনজিং, ‘আমি উঠেছিলাম এই জন্য, যেন তোমাদের আর কোনোদিন না উঠতে হয়। ’ পাঠক জানেন, দারিদ্র্যক্লিষ্ট শেরপাদের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস পর্বাতোরোহীদের মালপত্র বহন করা, এভারেস্টের বিপদসঙ্কুল পথে ট্রেকারদের পথ দেখানো। তেনজিং-এর কথায় সেই কষ্টই বেরিয়ে এসেছে- যাতে তেনজিং আশা করছেন এভারেস্টের খ্যাতি তাঁর জন্য আর্থিক সচ্ছলতা বয়ে আনবে, তাঁর সন্তানদের আর কষ্ট করে পর্বতারোহীদের মুট বয়ে জীবন চালাতে হবে না। ব্রিটিশ ক্লাইম্বার জর্জ ম্যালোরিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তিনি এভারেস্টে উঠতে চান; উত্তরে ম্যালোরি যা বলেছিলেন ক্লাইম্বিংয়ের ইতিহাসে তা প্রবাদপ্রতিম উক্তি হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি এভারেস্টে উঠতে চাই কারণ ওটা ওখানে আছে। ’ কিন্তু দুঃখজনক যে, ‘বিকজ ইটস দেয়ার’ উক্তির ম্যালোরি কোনোদিনই এভারেস্টে উঠতে পারেননি, ১৯২৪ সালে সামিট করতে যেয়ে তিনি ও তার সঙ্গী এন্ড্রু আরভিন নিখোঁজ হয়ে যান। হিলারি আর তেনজিং-এর এভারেস্ট জয়ের পর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহেরুর দার্শনিক মন্তব্যটি স্মরণযোগ্য; তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ মানুষের সাধ্য, দক্ষতা আর সক্ষমতার এমন বহিঃপ্রকাশ যা প্রমাণ করে মানুষ চাইলে পৃথিবীর তাবৎ সমস্যা, তা সে অন্যায় বৈষম্য দারিদ্র্য যাই হোক না কেন,  জয় করতে পারে। ’ ক’বছর আগে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে নেহেরুরর খোদাইকৃত ওই মন্তব্য পড়ে যারপরনাই অভিভূত হয়েছিলাম।
 
এটা হয়তো সত্যিই যে, মানুষ যত উপরে ওঠে ততই বিনয়ী হয় এবং ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। আমি যেহেতু ঈশ্বর বিশ্বাস করি না তাই আমার কাছে কেওক্রাডংয়ে  উঠে মনে হয়েছে প্রকৃতি ও অপার সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। আমার পায়ের নিচে কেওক্রাডং এটা বলাটা ভয়ঙ্কর ঔদ্ধত্য, এটা আমি পছন্দ করি না। কোনো মেয়েকে ভালোবাসলে আমরা যেমন বলি মেয়ে তুমি আমার, কিন্তু পাহাড়িরা বলে, মেয়ে আমি তোমার হয়ে গেলাম। আদিবাসীদের দার্শনিক বচনটি এ প্রসঙ্গে লক্ষযোগ্য: প্রকৃতি আমার নয়, আমিই প্রকৃতির। আমার কাছেও তাই মনে হয় পৃথিবী ও প্রকৃতি আমার না, আমিই পৃথিবী আর প্রকৃতির সন্তান। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো: ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে..। ’ পৃথিবীর মাঝে এই স্থান পাওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর! কেওক্রাডংয়ে গিয়ে পার্বত্য-দর্শনের এই নতুন দীক্ষা আমার হয়েছে। আর ফাংশনাল দিক হচ্ছে পর্বতে ওঠার শ্রম আপনার মধ্যে উচ্চতাভীতি দূর করে বাড়তি ‘কনফিডেন্স’ তৈরি করবে। যাদের কনফিডেন্স লেভেল কমে যাচ্ছে তারা এই থেরাপিটি কাজে লাগাতে পারেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক স্টিফেন স্কিমিড তো পর্বতে আরোহণের দার্শনিকতা নিয়ে ক্লাইম্বিং-ফিলোসফি ফর এভরিওয়ান নামে রীতিমত একটা বই-ই গ্রন্থনা করে ফেলেছেন। বইতে বলা হয়েছে পর্বতে ওঠা নিছক শারীরিক বিবেচনায় উচ্চতায় ওঠা নয়, মানসিক উচ্চতা নির্মাণেও এর আছে অসামান্য ভূমিকা। ক্লাইম্বিং মানুষের চরিত্র গঠন করে, ধৈর্যের অসীম পরীক্ষায় পাস করতে হয়, ব্যক্তিত্বে দৃঢ়তার বোধ তৈরি করে, মানুষের কল্যাণে ঝুঁকি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে; নৈতিক মনোবল বাড়ায়, কোনো কাজে অভিনিবিষ্ট হতে সাহায্য করে; পর্বতারোহণ মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে, প্রকৃতি আর মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায়; আর সবচেয়ে বড় কথা পার্বত্যপথে ভ্রমণশীলতার চর্চা মানুষকে মুক্ত-স্বাধীন আর বন্ধনহীন জীবনচেতনা গড়তে সাহায্য করে। স্কিমিড ক্লাইম্বিং-এর এথিকস আর দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
   
আমি, আইএলও’র আদিবাসী বিষয়ক কনসালট্যান্ট লিনা লুসাই, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ত্রিমিতা চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনোয়ার আর বম গাইড পানুয়াম ২৮ ডিসেম্বর ২০১১ বগালেক থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা হেঁটে কেওক্রাডংয়ে পৌঁছাই। এ যাত্রায় বগালেক পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিলেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের ছেলে রাজকুমার আর্য দেব আর ছিলেন অসাধারণ সংগীত প্রতিভা টিনটিন চাকমা, যদিও ওরা কেওক্রাডং পর্যন্ত যায়নি। আনোয়ার বহুবার কেওক্রাডং জয় করেছে। পাহাড় ওর প্যাশন। কয় দিন পর পরই ছুটে আসে পাহাড়ের টানে। ও থাকাতে দারুণ সুবিধা হয়েছে; পাহাড়ি পথে হাঁটার নানান টিপস ওর কাছ থেকে জেনিছি। কী করে ক্রস করে হাঁটতে হয়, কখন স্ট্রেচিং করতে হয়, কীভাবে লাঠি ধরতে হয়, দম নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এসব। হাঁটতে যখন কষ্ট হচ্ছিল তখন পার্বত্যপথে হাঁটায় তার গুরুর কাছ থেকে শেখা হাঁটার সহজ সংজ্ঞাও সে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছে; হাঁটা খুবই সোজা, হাঁটা মানে আর কিছুই না, ‘পেছনের পা টেনে সামনে আনা। ’ দারুণ সহজ কিন্তু কষ্টের সময় হাঁটা অব্যাহত রাখার জন্য খুবই যুৎসই ডেফিনিশন! কেওক্রাডংয়ে উঠে আমার এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়েছে। আমার মনে হয়েছে নিজেকে সুন্দরের কাছে সমর্পণ করছি। কুয়াশা ও হালকা বৃষ্টির মতো আবহাওয়া আচ্ছন্ন করে রেখেছিল চারপাশ। মালয়েশিয়ার গেন্টিং হাইল্যান্ডের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল হালকা বৃষ্টি আর আবছা কুয়াশায় তৈরি হওয়া ‘মিস্টগুলো’। এ আবহাওয়ার কারণেই ওখানে ওঠার পথটা ছিল পিচ্ছিল আর বন্ধুর। কেওক্রাডংই শেষ নয়, আমরা আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম।   মাইলখানেক দূরে আমরা পেলাম পাছিংপাড়া- বাংলাদেশের সবোর্চ্চ গ্রাম- তিন হাজার ফুট উঁচুতে। পাছিংপাড়া ঘুরে এসে আমরা ফিরতি পথে সমতলে আসতে থাকলাম। তবে যা অভিনব তাহলো, পর্বতে ওঠার চেয়ে নামা সহজ কিন্তু ঝুঁকি অনেক বেশি, পা ঠিক রাখা যায় না, পিছলে বেরিয়ে যায়।
 
কীভাবে যেতে হয় কেওক্রাডং? খুবই সোজা মনে পর্যাপ্ত জোর লোড করে ঢাকা থেকে বাসে চলে অসুন বান্দরবান, বান্দরবান সদর থেকে জিপে কাইক্ষ্যংছড়ি ৩০ কিমি, সেখান থেকে ১২ কিমি দূরে রুমা বাজার, যেতে হয় নৌকায়, রুমা থেকে ১৪ কিমি গেলে বগালেকের পাদদেশ। পাদদেশ থেকে নাক বরাবর খাড়া দুই কিমি পাহাড় বেয়ে উঠলে বগালেক তার উন্মুক্ত জলাশয় নিয়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে। বগালেক থেকে কেওক্রাডংয়ে আসা-যাওয়ার পথ বাইশ কিলোমিটার পথ। সাড়ে চার ঘন্টা যেতে আর আসতে লাগে চার ঘন্টা সময়। আমার মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে আমিই প্রথম সেখানে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে না হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে আমিই প্রথম এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। কিন্তু এটা বড় কথা নয়, আমি যা বলতে চাই তাহলো কেওক্রাডং ওঠা কোনো বড় বিষয় নয়; আপনি যদি একদিনে আট ঘন্টায় বাইশ কিলোমিটার হাঁটতে পারেন, তবে সহজেই কেওক্রাডং জয় করা বা তাঁর সৌন্দর্যসম্ভোগ করা সম্ভব। পাহাড়ে ওঠা তেমন কোনো কষ্টের বিষয় নয়, এ অভিযানের মধ্য দিয়ে পর্বতারোহণের বিষয়টিকে আমি তাই ‘ডিমিস্টিফাই’ করতে চেয়েছি; পর্বতে ওঠার জন্য শারীরিক সক্ষমতা কোনো বিষয় নয়, আন্তরিক চাওয়া আর সৎ ইচ্ছেই যথেষ্ট। বিদেশে মানুষ তাদের পেশার বাইরে অদ্ভুত সব কাজ করে, নানা রকম অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের এখানে এরকম চেষ্টা খুব কম।

তবে যেটা শঙ্কার বিষয় তা হলো এক সময় এখানে কর্পোরেট অর্থায়নে পর্যটন শুরু হবে। এরই মধ্যেই তার ইঙ্গিত-নমুনা টের পাওয়া যাচ্ছে। এটা হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অনেকটাই বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়; এতে করে পাহাড়িরা তাদের জমি-জিরাত হারাতে পারেন। পর্যটন গড়ে উঠলেও প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। দুটির মধ্যে একটি সমন্বয় করতে হবে। ওখানে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে। প্রকৃতি আর প্রকৃতির সন্তানদের জীবনকে কোনো অবস্থাতেই বিরক্ত করা যাবে না। এখন যতটুকু পর্যটন সেখানে হচ্ছে তা হচ্ছে স্থানীয় আদিবাসীদের আন্তরিক ব্যবস্থাপনায়। কাজেই তাদের সম্পৃক্ত করেই পর্যটন বিকাশের উদ্যোগটি নেওয়া উচিত। কারণ এখনই দেখছি, প্রচুর সংখ্যক পর্যটক সেখানে যাচ্ছে কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশকে তারা ঠিক বিবেচনায় নিচ্ছে না। কেওক্রাডংয়ে আসা-যাওয়ারা পথে দেখেছি প্রচুর পলিথিন, চানাচুরের প্যাকেট, সিগারেটের বাট ইত্যাদি পড়ে আছে। এগুলো যেহেতু অর্গ্যানিক উপাদান নয়, তাই সহজে পচবে না, ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পর্যটক হিসেবে যারা যান তাদের এই বিষয়টিতে খুবই সচেতন থাকা উচিত। এখানে স্যানিটেশনের সম্যস্যা আছে। ভালো রাস্তা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

এরপর? এরপর ইচ্ছা আছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তাজিনডং এবং প্রথম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাফা হাফলং ছোঁয়ার আর পর্বতশিখরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পিত করার; আর ইচ্ছে উঁচুতে নিজেকে স্থাপন করে আবারও আকাশের সৌন্দর্যসম্ভোগের।
 
রোবায়েত ফেরদৌস : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।