বরিশাল: ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এবার একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেইসঙ্গে সরকার ও নির্বাচন কমিশনও ইতিহাসের সেরা নির্বাচন দেশবাসীকে উপহার দেওয়ার কথা বলছে।
যদিও সরকার পতনের পর থেকেই রাজনীতির মাঠে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মাঝে বেশ আগ্রহ রয়েছে। তবে গত কয়েকমাস ধরে সংসদীয় এলাকায় নির্বাচনী উত্তাপ অনেকটাই বেড়েছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণাও বেড়েছে সংসদীয় এলাকায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও জোটের শরিক দলগুলো ছাড়া বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন। নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার আগেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বরিশাল জেলার ছয়টি আসনে তাদের প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছে। যার মধ্যে বরিশালের প্রবেশদ্বার খ্যাত গৌরনদী-আগৈলঝাড়া উপজেলা মিলিয়ে বরিশাল-১ আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী হচ্ছেন মাওলানা কামরুল ইসলাম খান। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হাতে থাকা এ আসনে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনও প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি। তবে এ দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা একাধিক, যাদের বেশিরভাগের আয়ের উৎস ব্যবসা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় সংসদের ১১৯ নম্বর আসন বরিশাল-১ এর নির্বাচনী এলাকার গৌরনদী উপজেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন তিন নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন এ আসনের সাবেক এমপি (১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন) ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল।
পাশাপাশি এ আসনের আগৈলঝাড়া উপজেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান। তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন।
বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রত্যেকেই মানুষের কল্যাণে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বাংলানিউজকে জানিয়েছেন।
জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা কামরুল ইসলাম খান বলেন, বিগত সরকার অনেক জটিলতা সৃষ্টি করে গেছে, অর্থনৈতিক কাঠামো, বিচার ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার সেগুলো গুছিয়ে মোটামুটি পর্যায়ে আসতে পারলে নির্বাচন হবে। এলাকার সাধারণ মানুষের মুখের কথায় যেটা বুঝতে পারছি, তারা এ মুহূর্তে নির্বাচন বিমুখ, তবে আশা করি সুন্দর একটি নির্বাচন হবে। কারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার যা পারে অনির্বাচিত সরকার তা করতে পারে না। আগের নির্বাচনগুলো একটা সরকারের অধীনে হয়েছে, যেখানে দিনের ভোট রাতে কিংবা ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। এমনকি ৩শ’ আসনে ভোট হওয়ার আগেই ১৬০ জন নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এসব কাটিয়ে এবার ফেয়ার নির্বাচিত হবে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, চোর, ডাকাত, অর্থপাচারকারীরা ঘরে ঘুমাতে পেরেছে। কিন্তু বিনাদোষে কোনো মামলার আসামি না হয়েও ৭৬ দিন বাসায় থাকতে পারিনি। বিনা কারণে জেল খেটেছি। তারপরও জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। জনপ্রতিনিধি হলে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সবাইকে নিয়ে সংসদীয় আসনের উন্নয়নে কাজ করবো। আমি নির্বাচিত হলে বিগত সময়ের মতো কোনো কাজে দলবাজি থাকবে না।
এদিকে তথ্য বলছে, এ আসনটিতে ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৮সাল পর্যন্ত ৮টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একবার জাতীয় পার্টি বিজয়ী হলেও বাকি ৭ বারের মধ্যে চারবার আওয়ামী লীগ ও তিনবার বিএনপি নির্বাচিত হয়েছে। যার মধ্যে প্রার্থীর তালিকায় থাকা বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ভোটের মাঠে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান। বিএনপির অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের মতো গত ১৬-১৭ বছরে একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান। তার বিরুদ্ধে শুধু ঢাকাতেই ১২টি মামলা হওয়ার তথ্য যেমন রয়েছে, তেমনি এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও গত ১৭ বছরে একাধিক মামলা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার শুধু যে মামলাই করেছে এমনটা নয়, হামলাও হয়েছে আমিসহ বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর।
তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালে ঢাকা কলেজে পড়াশোনার সুবাদে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছি। শুধু নেতাকর্মীদের পাশেই নয়, রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মানুষের কল্যাণেও কাজ করেছি। আর সেক্ষেত্রে যদি জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের কল্যাণে আরও বেশি কাজ করা যায় তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করাটা খারাপ কিছু না।
আর বাবাকে দেখে মানুষের সেবায় এগিয়ে যাওয়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহানের প্রধান উদ্দেশ্য জনগণের সেবা করা, তাই তিনিও সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন, আমার বাবা ছিলেন আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের ১৫ বছরের জননন্দিত চেয়ারম্যান, ছোটবেলা থেকে তাকে দেখেছি সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে। আর সেখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৮৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসি। অনেক দল ছিল যেকোনো দলেই যেতে পারতাম, তবে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কর্মকাণ্ড দেখে বিএনপির ওপর আকৃষ্ট হই। তাই সেই থেকে এ পর্যন্ত আমি ও আমার পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত আছি। যখন যেভাবে পেরেছি নেতাকর্মী ও নিজ এলাকার মানুষদের পাশে থেকেছি।
যদিও মামলায় না জড়ালে প্রচার-প্রচারণার সুযোগ পেলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হতেন বলে মনে করেন এই প্রার্থী। সেক্ষেত্রে কিছুটা আক্ষেপ আছে ওই নির্বাচনে ৪৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে ৭৪ হাজার) ভোট পাওয়া প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহানের।
শুধু যে মামলা হয়েছে এমনটাই নয়, জেলও খেটেছেন এ আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীরা। বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যেমন একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন, তেমনি অনেক মামলায় রিমান্ডের নামে নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন। পাশাপাশি একাধিকবার তার বাড়িঘর ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে নিজ এলাকায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করতে হয়েছে জহির উদ্দিন স্বপনকে।
এদিকে দলীয় নেতাকর্মীরা জানায়, তৃণমূলের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজলের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হামলা-মামলার শিকার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় তিনি বিনা পয়সায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন করিয়েছেন, যা করাতে গিয়ে তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের চাপেও ছিলেন, তারপরও তিনি ছিলেন নেতাকর্মীদের আশ্রয়স্থল।
অপরদিকে জামায়াত-বিএনপির বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও বিগত দিনের মতো এ আসনে প্রার্থী দেবে বলে জানা গেছে, তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া মেহেদী হাসান রাসেল আবারও প্রার্থী হবেন কি না কিংবা নতুন কেউ আসছেন কি না সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
৩ লাখ ভোটারের এ আসনের তরুণ ভোটার মো. হাসান বলেন, বিগত প্রায় দেড় যুগের নির্বাচন আমরা দেখেছি, এবার এমন একটি নির্বাচন চাই যেখানে বিনা বাধায় গোপনীয়তা বজায় রেখে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে সবাই। আর সেটা নিশ্চিত হলে যোগ্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, যদি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন হয়, তাহলে বিষয়টি অনেক জটিল হতে পারে। তাই মন্তব্য পুরো বিষয়টি না বুঝে নয়। তবে যদি পূর্বের নিয়মে কিছু সংশোধন এনে নির্বাচন করা হয় তাহলে মানুষ সাবধান হবে এবং বিগত দিনের সমস্যা ও সংকট থাকবে না বলে মনে হচ্ছে।
এমএস/এজে