উন্নয়নে মুগ্ধ হয়ে মানুষ আবারও নৌকায় ভোট দেবে বলে দাবি আওয়ামী লীগের। বিপরীতে বিএনপির নেই তেমন কোনো প্রচারণা কিংবা গণসংযোগ।
সিরাজগঞ্জ পৌরসভাসহ সদরের পাঁচটি ইউনিয়ন এবং কামারখন্দ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন নিয়ে সিরাজগঞ্জ-২ আসন গঠিত। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ৫৩ হাজার ৬০৩। সদরের ইউনিয়নগুলো হলো শিয়ালকোল, খোকশাবাড়ি, কাওয়াকোলা, কালিয়া হরিপুর ও সয়দাবাদ এবং কামারখন্দের ঝাঐল, ভদ্রঘাট, জামতৈল ও রায়দৌলতপুর ইউনিয়ন।
জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ আসন হওয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নজর থাকে এখানে।
এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ননদের স্বামী অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না আবারও নৌকার টিকেট পাচ্ছেন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
প্রার্থী হতে চান ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরাজিত প্রার্থী ড. জান্নাত আরা হেনরীও। তবে এখানে মিল্লাত মুন্নাকে সামনে রেখেই চলছে নৌকার প্রচারণা।
অপরদিকে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদের নেতৃত্বে এখানকার বিএনপি একাট্টা। ধানের শীষ প্রতীক তিনিই পাচ্ছেন-এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে কোনো কারণে তিনি নির্বাচন করতে না পারলে তার স্ত্রী জেলা বিএনপির সভাপতি, সাবেক এমপি রুমানা মাহমুদ নির্বাচন করতে পারেন বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। দলের কেন্দ্রীয় সদস্য মেজর (অব.) হানিফ ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা মোস্তফা জামানও মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় নেই দলটির কোনো নেতাই।
ধানের শীষের বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে বলে বিএনপি দাবি করলেও পঞ্চম সংসদ নির্বাচন থেকে প্রতিটি নির্বাচনই হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এর মধ্যে তিনটিতে জয় পায় বিএনপি, বাকি দু’টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে (এর মধ্যে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় জয়ী হয় আওয়ামী লীগ)।
বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংসদীয় আসন পুনরায় বন্টনে আওয়ামী দুর্গ হিসেবে পরিচিত উত্তর সিরাজগঞ্জের চারটি ইউনিয়ন এ আসন থেকে বাদ দিয়ে কাজিপুরের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অপরদিকে, উভয়দলের সমসংখ্যক ভোটের কামারখন্দ উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগ করা হয়। যার ফলে এ আসনটিতে বিএনপির দাপট রয়েছে।
তবে এসব হিসাব-নিকাশ একেবারেই মানতে নারাজ সরকার দলের সমর্থকরা। তাদের দাবি, টানা দুই টার্ম ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এমপি মিল্লাত মুন্নার নেতৃত্বে দৃশ্যমান উন্নয়ন ভোটারদের কাছে টানবে। বর্তমানে দলের সাংগঠনিক ভিতও বেশ শক্তিশালী। প্রতিটি ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে দলকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। শত শত উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন প্রচার করেছেন সাংসদ মিল্লাত মুন্না। এসব দিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের ভোট আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারাদেশে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হলেও এ আসনটি চলে যায় বিএনপির ঘরে। ২০১০ সালে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেনের জামাতা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না সিরাজগঞ্জের রাজনীতিতে আসেন। ২০১১ সালে তাকে সিরাজগঞ্জের উন্নয়ন সমন্বয়কের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী। তখন থেকেই স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বদ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়ার মৃত্যুতে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকেও সামলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিকিৎসক। ক্লিন ইমেজের নেতা হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে।
তবে জেলার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তার সমর্থকদের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সমর্থকদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিষয়টি বাইরে প্রকাশ না হলেও দলের ভেতরে চাপা গুঞ্জন রয়েছে। নির্বাচনের আগে দ্বন্দ্ব নিরসন না করলে এর প্রভাব ভোটের মাঠে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, এখানে কোনো দ্বন্দ্ব বিভেদ নেই। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আওয়ামী লীগ এখন অনেক শক্তিশালী ও সুসংগঠিত।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপি বলেন, সারাদেশেই নৌকার একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। এছাড়া সৎ ও যোগ্য প্রার্থী দেখেও জনগণ ভোট দেয়। এর সঙ্গে রয়েছে উন্নয়ন। সাড়ে চার বছরে সিরাজগঞ্জে যে উন্নয়ন হয়েছে, ৪৭ বছরের ইতিহাসে তা হয়নি। এ কারণে মানুষ আবারও স্বাধীনতা ও উন্নয়নের প্রতীক নৌকা মার্কাকেই বিজয়ী করবে।
তার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যমুনার ভাঙ্গন থেকে সিরাজগঞ্জবাসীকে রক্ষা, জোট সরকারের আমলে বন্ধ হওয়া কওমি জুটমিল চালু করে হাজারো শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি, সয়দাবাদে ছয়শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র, মুলিবাড়িতে মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা একশ’ থেকে বাড়িয়ে আড়ইশ’ করাসহ অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। শেষ পর্যায়ে রয়েছে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ নির্মাণ কাজ। শিল্পপার্ক ও ইকোনমিক জোনের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মুলিবাড়ি-নলকা ফোরলেন মহাসড়ক নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। অপরদিকে, অবহেলিত কামারখন্দ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের সব সড়ক পাকা করাসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থেই মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে।
তিনি বলেন, সাংগঠনিক দিক থেকে ৪৭ বছরের ইতিহাসে সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ এখন সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচার, চাঁদাবাজির কারণে মানুষ তাদের প্রতি বিতশ্রদ্ধ। বিএনপি কখনওই সিরাজগঞ্জের উন্নয়ন করেনি- এটি সবাই জানে। ২০১৩ ও ১৪ সালে বোমাবাজি, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে-এগুলো জনগণ কখনওই মেনে নেবে না।
বিএনপির বৃহৎ ভোট ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পূর্ববর্তীকালে মুসলিম লীগ নামে একটি শক্তিশালী দল ছিল। স্বাধীনতার পর তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু সিরাজগঞ্জ নয় এক সময় পুরো উত্তরবঙ্গে বিএনপি শক্তিশালী ছিল। আওয়ামী লীগের উন্নয়নের রাজনীতির বিপরীতে দুর্নীতি, অগ্নিসন্ত্রাস আর জ্বালাও পোড়াও করে তাদের অবস্থা আজ মুসলীম লীগের মতো হয়েছে।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। জেলা বিএনপির রাজনীতি তার হাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০০৮ সালে মামলা জটিলতার কারণে তিনি নির্বাচন করতে না পারায় তার সহধর্মিনী রুমানা মাহমুদ দলের মনোনয়ন পান। টুকুর ব্যাপক জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়েই গৃহবধূ থেকে সংসদে জায়গা করে নেন রুমানা মাহমুদ।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলানিউজকে বলেন, এই মুহূর্তে দেশে নির্বাচন করার কোনো পরিবেশ নেই। আমাদের মিটিং করতে দেওয়া হয় না। শান্তিপূর্ণ সভা করতে গেলেও পুলিশ দিয়ে বাধা দেওয়া হয়। সরকার চায় না বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো নির্বাচনে আসুক।
তিনি বলেন আরও বলেন, সরকার ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো মানলে নির্বাচনে সিরাগঞ্জের সবকটি আসন বিএনপি পাবে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ-২ আসন বিএনপির দুর্গ। মাঠ পর্যায়ে আমাদের বড় একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পেয়ে ধানের শীষ বিজয়ী হবে।
এছাড়া জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আমিনুল ইসলাম ঝন্টু, বাসদের নব কুমার কর্মকার ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি মুহিব্বুল্লাহ স্ব স্ব দল থেকে নির্বাচন করতে পারেন। তবে এখানে বিএনপির সঙ্গেই আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৮
এসআই