শুধু নেই সংঘাত-সহিংসতা বা মারামারি-কাটাকাটি। জেলার অন্য উপজেলার তুলনায় রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যাও নগণ্যই বটে! এমনকি ঘনিয়ে আসা ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা নেই কারও মনে।
রাজনৈতিক সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চিত্র এটি। গভীর রাতে চায়ের দোকানের প্রাণবন্ত আড্ডায় স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি’র নেতাদের সৌভ্রাতৃত্ব পূর্ণ এমন দৃষ্টান্তই তুলে ধরছিলেন দলগুলোর তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
উপজেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে স্থানীয় কেশরগঞ্জ বাজার এলাকা। কিন্তু ভাঙাচুরা বেহাল সড়কের কারণে এ সামান্য পথটুকু পাড়ি দিতেই বেগ পেতে হয়। নাওগাঁও ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল এ বাজারের প্রতিটি চায়ের দোকানেই রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা জমে ওঠে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের কাজের হালখাতা, সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে নির্বাচনের চালচিত্র কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে।
বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) দিনগত রাত দেড়টার দিকে নবী মিয়ার চায়ের দোকানে রীতিমতো ঝড় তোলতে দেখা গেলো যুবা থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী এবং বয়োবৃদ্ধদেরও।
তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনীতির পাশাপাশি কেউ ব্যবসা করেন, কেউ গাড়ি চালান, আবার কেউ এনজিওকর্মী।
মধ্যরাতেও নবীর দোকানে চায়ের গরম কাপে ধোঁয়া উঠছে। বেচা-বিক্রিও ভালো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রত্যেকের কথাই সম-সাময়িক রাজনীতি নিয়ে।
তাদের আলাপে যোগ দিয়ে স্থানীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতেই কথা টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলেন বিল্লাল হোসেন (৪০)। তিনি স্থানীয় নাওগাঁও ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক।
‘আমাদের এখানে কোনো রাজনৈতিক হানাহানি বা মারামারি নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কোনো ভেদাভেদও নেই। আমরা সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে এক দোকানে বসে প্রতিরাত বা সকালে চা খাই। সবজায়গায় গন্ডগোল থাকলেও ফুলবাড়িয়া শান্তই থাকে’ একদমেই যেন বলে যাচ্ছিলেন বিল্লাল।
তার কথার সঙ্গে যোগ করে পেশায় এনজিওকর্মী অরবিন্দ বলেন, ‘ফুলবাড়িয়ায় দুই দলই (আওয়ামী লীগ-বিএনপি) সমঝোতার রাজনীতি করে। এ কারণেই এলাকায় অশান্তি নেই। মানুষ শান্তিতে বাস করছে। ’
‘হহ ঠিক ঠিক’ বলে বিল্লাল ও অরবিন্দের কথায় সায় দিলেন সবাই। তবে এবার স্থানীয় রাজনীতির আলোচনার পারদে নতুন মাত্রা এনে দিলেন নাওগাঁও ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ।
তার ভাষ্যে- ‘গত সংসদ নির্বাচনের সময় বিএনপি’র লাগাতার হরতাল-অবরোধের কোনো প্রভাব পড়েনি ফুলবাড়িয়ায়। হরতাল হলেও কোনো যান চলাচলে বাঁধা দেওয়া হয় না। একে অন্যকে মামলায় ফাঁসানো হয় না। এর মানে আমাদের এলাকার রাজনীতিকরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করেন না। সম্প্রীতি বজায় রেখেই পাশাপাশি পথ চলেন। এমনকি সবাই মিলে-মিশে একসঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যও করে। ’
‘একই পরিবারের দুই সদস্য (ভাই) দুই দল করেন। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি। ’ স্থানীয় জয় চন্দ্র দে সম্প্রীতির আরেকটি নজির উপস্থাপন করলেন। তবে একটি উদাহরণ দিয়ে পুরো বিষয়টি খোলাস করে দিলেন যুবদল নেতা বিল্লাল।
তিনি বলেন, উপজেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি চান মাহমুদ। আবার তাঁর ভাই লাল মাহমুদ আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতি করেন। এমন অনেক আছে বড় ভাই আওয়ামী লীগ, আবার ছোট ভাই বিএনপি’র রাজনীতি করেন।
আমাদের দলের নেতা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বাদশা ও চান মাহমুদসহ আরও অনেকেই এ সরকারের সময়েও ঠিকাদারি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নেতারাও তাদের বিরক্ত করছেন না। ’
চায়ের আড্ডার শেষভাগে মুখ খুললেন স্থানীয় ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান ও স্থানীয় রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন।
‘৩০ ডিসেম্বরের ভোট নিয়ে এখানকার বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই। সবাই নির্বিঘ্নে উৎসব পরিবেশে ভোট দিতে যাবেন’, এমন কথা ছুঁড়ে দিলেন তাঁরা।
অভিন্ন সুরে স্থানীয় যুবদল নেতা বিল্লালও বললেন, ১০ বছর পর বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ একটি ভোট আমাদেরও প্রত্যাশা।
সুষ্ঠু ভোটেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হোক। ’ একই রকম কথা বলেন বয়স্ক আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিনও।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৮
এমএএএম/ওএইচ