সিরাজগঞ্জ: কখনো জমি বিক্রি আবার কখনো বন্ধকি, আবার চাকরি দেবার নাম করে গাঁয়ের সহজ-সরল মানুষকে ভুলিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি। এছাড়া দরিদ্রদের নিয়ে সমিতি করে চাঁদার টাকাও আত্মাসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এভাবেই শতাধিক মানুষের প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি গোলবার হোসেনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম ফরিদুল।
এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামারখন্দ আমলি আদালতে নয়টি মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা।
অপরদিকে হতদরিদ্র সমবায় সমিতি নাম দিয়ে একশ’ জন সদস্যের পাঁচ লাখেরও বেশি টাকা আত্মাসাতের বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
রোববার (২ জুলাই) সরেজমিন কামারখন্দ উপজেলার গাড়াবাড়ী ও পাশের উল্লাপাড়া উপজেলার ধুনচি গ্রামে গেলে ভুক্তভোগী অসংখ্য নারী ও পুরুষ একে একে তাদের অভিযোগ জানাতে থাকেন।
গাড়াবাড়ী গ্রামের কৃষক ফরহাদ আলী বলেন, রিকশা চালিয়ে আর কৃষি দিনমজুরি করে টাকা জমিয়েছিলাম। কষ্টার্জিত টাকার মধ্যে আড়াই লাখ দিয়ে দুই বিঘা জমি বন্ধক নেই আশরাফুলের কাছ থেকে। এরপর তিনি তার ১৮ শতক জমি বিক্রি করতে চাইলে কেনার জন্য আরও সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েছি। টাকা নেওয়ার কয়েকদিন পরই পালিয়ে গেছেন আশরাফুল।
একই গ্রামের রাশেদা বেগম বলেন, আমার স্বামীর সঙ্গে খাতির ছিল আশরাফুলের। এ সুবাদে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দুই লাখ ৯১ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম। এক মাসের মধ্যে ফেরত দেওয়ার কথা, এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। চর গাড়াবাড়ী গ্রামের আনিছা বেগম বলেন, পিয়ন পদে ছেলেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন আশরাফুল। এরপর থেকেই খোঁজ নেই তার।
এভাবে গাড়াবাড়ীর ফরিদুল ইসলামের কাছ থেকে ধার এক লাখ ৮০ হাজার, দুই বিঘা জমি বন্ধক রেখে রাবেয়ার কাছে দুই লাখ ২০ হাজার, এক বিঘা জমি বন্ধক, আছিয়া বেগেমর কাছে এক লাখ ৪০ হাজার, জমি বন্ধক বাবদ গাড়াবাড়ীর তাহমিনা খাতুনের আড়াই লাখ ও উল্লাপাড়া উপজেলার ধুনচি গ্রামের ঠান্ডু আকন্দের কাছে ধার বাবদ দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
অপরদিকে হতদরিদ্র সমবায় সমিতির একশ’ জন সদস্যের গচ্ছিত পাঁচ লাখ এক হাজার টাকাও ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নিয়েছেন বলে আদায়কারী জিল্লুর রহমান জানান। প্রতারিত এসব ভুক্তভোগী প্রত্যেকেই আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে মামলা করেননি প্রতারিত এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক। উল্লাপাড়া উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের আব্দুল লতিফের কাছে সাত লাখ ২৫ হাজার, আত্মীয়তার সুবাদে একই গ্রামের রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে চার লাখ ৪০ হাজার, একই উপজেলার ধুনচি গ্রামের রতন কুমার দাসের কাছে এক লাখ ৫৫ হাজার, সুনীল চন্দ্র দাসের ৭০ হাজার, অনিল দাসের ২০ হাজার, রায়গঞ্জ উপজেলার পাঙ্গাসী গ্রামের নরেশ দাসের এক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এছাড়া ধুনচি পাটনিপাড়ায় ২৮ জন সদস্য নিয়ে গঠিত সমিতির জমাকৃত সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন আশরাফুল।
ভুক্তভোগী ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশরাফুল ইসলাম ফরিদুল প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গোলবার হোসেনের ছেলে, তাদের বেশ জমিজমাও রয়েছে। এছাড়া বাবা-ছেলে দু’জনেই কামারখন্দ রেজিস্ট্রি অফিসের স্ট্যাম্প ভেন্ডার। এসব কারণে খুব সহজেই কয়েক মাসের মধ্যেই আত্মীয়তা কিংবা বন্ধুত্বের সুবাদে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। টাকা নেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিখোঁজ হন। অনেকদিন খোঁজ না পেয়ে ভুক্তভোগীরা তার বাবার কাছে গেলে তিনি সবার টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবে প্রায় দেড় বছর ধরে সময় নিতে থাকেন গোলবার হোসেন। একপর্যায়ে আব্দুল মালেক, আব্দুল মজিদ ও কালাম মেম্বরসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে তার বাবা গোলবার হোসেনের কাছে গেলে তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করেন। বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা সালিশ বৈঠকের আয়োজন করলে সেখানেও অনুপস্থিত ছিলেন গোলবার হোসেন।
এভাবে দীর্ঘ সময় পার হবার পর একে একে আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। এসব মামলায় আশরাফুল ইসলাম ফরিদুল ছাড়াও তার বাবা গোলবার হোসেন, স্ত্রী রহিমা বেগম এবং শ্যালক দুলাল মাস্টার ও বোন জামাই আমিনুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাসিম সরকার হাকিম নয়টি মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
গাড়াবাড়ী গ্রামের মাতব্বর আব্দুল মালেক জানান, বেশ কয়েক বছর আগে আশরাফুল ইসলাম ফরিদুল গাঁয়ের অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। আমরা তার বাবাকে বার বার বলেছি, কমবেশি করে টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু সামর্থ্য থাকলেও তিনি ওই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না।
এসব বিষয়ে জানতে পলাতক আশরাফুল ইসলাম ফরিদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার বাবা আওয়ামী লীগ নেতা গোলাবার হোসেন বলেন, আমার ছেলে কোনো টাকা নেয়নি। টাকা নেওয়ার কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না।
তার ছেলে কোথায় আছে জানতে চাইলে বলেন, তিন বছর ধরে আমার ছেলেকে গুম করে রেখেছে ওইসব সন্ত্রাসীরা। গুমের বিষয়ে থানা বা আদালতে কোনো অভিযোগ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওদের ভাগ্য ভালো যে আমি এখন পর্যন্ত গুমের কোনো মামলা করি নাই।
কামারখন্দ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সুপার বরাবর গাড়াবাড়ী এলাকার একটি সময়বায় সমিতির টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। আমরা সেটির তদন্ত করছি।
কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেরিনা সুলতানা জানান, জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে তদন্তের জন্য চিঠি পেয়েছি। এরই মধ্যে তদন্তের জন্য উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল্লাহ সবুজ বলেন, প্রায় আড়াই বছর আগে গোলবার ভেন্ডারের ছেলে আশরাফুল ইসলাম ফরিদুল এলাকার মানুষের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা শুনেছিলাম। তবে এসব বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৬ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০২১
এসআই