কুমিল্লা: গোমতী নদী পাড়ের কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে (কুসিক) চলছে উৎসব-শঙ্কার ভোট। সারাদেশ মুখিয়ে আছে সুপ্রাচীন এই জনপদের নির্বাচনের দিকে।
এই নির্বাচনকে ঘিরে নানা রকমের হিসেবে কষছেন রাজনীতি পাড়া থেকে শুরু করে মহল্লার সাধারণ মানুষ। তবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে কে বসবেন তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ জুন সন্ধ্যা কিংবা রাত পর্যন্ত। নানা কঠিন সমীকরণের কারণে এর আগে জোরালো ভাবে কিছুই বলতে চান না কেউ।
কুমিল্লার সাধারণ মানুষের মুখে যে প্রশ্নটি বারবার আসছে তা হলো অপ্রতিরোধ্য সাক্কুর হ্যাট্টিক ঠেকাবে কে। রিফাত নাকি কায়সার। নাকি অন্য কেউ।
এবারের কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচ জন থাকলেও কুমিল্লার আমজনতা বলছেন লড়াই হবে তিন হেভিওয়েটকে কেন্দ্র করে। ভোটের মাঠের সব সমীকরণ আবর্তিত হচ্ছে এই তিনজনকে কেন্দ্র করেই। দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু কি এবার হ্যাট্রিক করবেন নাকি প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের নৌকাকে সিটি করপোরেশনে নিতে পারবেন আরফানুল হক রিফাত। নাকি এই দুইজনকে মাড়িয়ে চমক দেখাবেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কৃত নিজাম উদ্দিন কায়সার।
কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন এ নির্বাচনে কায়সার বড় চমক দেখাতে পারেন। তবে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত।
অপরদিকে সাক্কুও কম চান না, ২০০৫ সালে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান কামরুল হাসানের মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে তিনি প্রথম কুমিল্লা আদর্শ সদর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ চেয়ারম্যান পদকে স্থগিত করলে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার আপিল নিষ্পত্তি হয়। তখন থেকে পদবী হয় পৌর মেয়র।
২০১১ কমিল্লা সদরের ১৮ ওয়ার্ড ও সদর দক্ষিণের নয়টি ওয়ার্ডকে এককীভূত করে প্রথমবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। ২০১২ সালে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে প্রয়াত বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ আফজাল খানকে ৩৫ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। পরে ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য আনজমু সুলতানা সীমাকে ১১ হাজার ভোটে পরাজিত করেন। সেবার তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচন করেছিলেন। তবে নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পা ছুয়ে সালাম করে আলোচনায় আসেন। কুমিল্লার সাধারণ মানুষ বলছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে বারবার কারিশমা দেখিয়েছেন সাক্কু।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর দুই মেয়াদের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। দলীয় প্রতীক বিহীন প্রথম নির্বাচনে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাক্কু হারান কুমিল্লা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আফজাল খানকে।
এরপরের নির্বাচনে আফজাল খান কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে পরাজিত করেন ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা সাক্কু।
কুমিল্লার সাধারণ মানুষ বলছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের আফজাল-বাহার দ্বন্দ্বের ফায়দা লুটতে পেরেছিলেন সাক্কু। এবারের নির্বাচনেও সে ফন্দি এঁটেছেন তিনি। বলছেন স্থানীয়রা।
তবে এবারের প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখছেন সব মহল। এবার আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের কাছের মানুষ খ্যাত আরফানুল হক রিফাত। রিফাতের পক্ষে ভোটের মাঠে নেমেছেন বাহাউদ্দিনের পরিবারের সদস্যরা।
অপর দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিযোগ করছেন আ ক ম বাহাউদ্দিন রিফাতের পক্ষে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছে। নির্বাচন কমিশন বাহারকে এলাকা ছাড়ার কথা বললেও তিনি ছাড়েননি। এ নিয়ে সারাদেশে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা।
এদিকে অপ্রতিরোধ্য সাক্কুকে ঠেকাতো ভোটের মাঠে আলোচনায় ছিলেন বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কুমিল্লার বিএনপির রাজনীতিতে মনিরুল হক সাক্কু এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিনের দীর্ঘকালের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এবার নির্বাচনে লড়াই করা নিজাম উদ্দিন কায়সার এই হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিনের নিকট আত্মীয়।
তাই রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন বিএনপির ভোট বিভক্ত হবে, এতে নগর ভবন থেকে আউট হতে পারেন মনিরুল হক সাক্কু। বিগত দুই বার কুমিল্লায় বিএনপির যে বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে তার ওপর একক আধিপত্য বিস্তার করলেও এবার সে সুযোগ পাবে না বলে মনে করছেন ভোটাররা।
এ নির্বাচনে মেয়র পদে ছয় জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। এরা হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত আরফানুল হক রিফাত (নৌকা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. রাশেদুল ইসলাম (হাতপাখা), স্বতন্ত্র হিসেবে কামরুল আহসান বাবুল (হরিণ), মো. মনিরুল হক সাক্কু (বিএনপি নেতা ও দুই বারের মেয়র) (ঘড়ি), মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার (ঘোড়া) ও মাসুদ পারভেজ খান । এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাসুদ পারভেজ খান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। অর্থাৎ মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচ প্রার্থী।
এছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর মিলে ১৪০ জনের মতো প্রার্থী আছে ভোটের মাঠে। এ নির্বাচনে ৫ নম্বর ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডে দু'জন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
কুমিল্লা সিটিতে ভোটগ্রহণ হবে সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ৬৪০টি ভোটকক্ষে।
কুসিকের ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার রয়েছে ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এদের মধ্যে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন নারী ভোটার এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন।
নির্বচনে জয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত বলেন, নগরের মেয়র পদটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চাই।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের উন্নয়নের জোয়ার এখন চারিদিকে। পদ্মা সেতুর ছবি এখন সবার চোখে চোখে সেই দৃশ্যপট দেখে মানুষ নৌকাতেই ভোট দেবে।
তিনি আরও বলেন, দলে এখন কোনো বিরোধ নেই। কালো টাকা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবার নৌকার জয় হবে। সাবেক মেয়র উন্নয়ন করেননি। মানুষ উন্নয়নের জন্য ভোট নৌকাতেই দেবেন।
বিএনপি থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃত টানা দুই বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বলেন, জনগণের অনুরোধেই তিনি প্রার্থী হয়েছেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে আছি। জনগণের সেবা করেছি তাই জনগণ আমাকে তাদের সেবার জন্য আবার নির্বাচিত করবে।
অপরদিকে আলোচিত প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, নগরবাসী এবার পরিবর্তন চায়, তারা তারুণ্যকে বেছে নেবেন। সৎ প্রার্থীকে বেছে নেবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২২
এসএইচডি/আরআইএস