ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

যুক্তির যৌক্তিক মূল্যায়ন হবে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৫
যুক্তির যৌক্তিক মূল্যায়ন হবে

ঢাকা: টানা চার দিনব্যাপী গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গণশুনানি শেষ হলো। সব বিতরণ কোম্পানি একই হারে (গড়ে ৪০ শতাংশ)দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়।



তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটির কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বিজিডিসিএল’র (বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) গ্যাসের মূল্য ২.৪৯ শতাংশ ও পিজিসিএল’র (পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ) গ্যাসের মূল্য ৫.৫৯ শতাংশ এবং জেজিটিডিসিএল’র (জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড) গ্যাসের মূল্য ৪.৯৮ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে।

ভোক্তাদের যুক্তির যৌক্তিক মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিইআরসি’র চেয়ারম্যান এ আর খান।

চেয়ারম্যান বলেন, কমিশন স্বচ্ছ। লুকানো-ছাপানো কিছু করবে না। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আদেশ দেবো।

তিনি বলেন, ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে। এটা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। অনেক বিষয় এসেছে। এগুলো বিশ্লেষণ করতে সময়ের প্রয়োজন। তাই একটু দেরি হবে আদেশ দিতে।

তিনি বলেন, প্রস্তাবের আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে বিষয়গুলোও বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।

বিতরণকারী তিন কোম্পানি টিজিটিডিসিএল (তিতাস গাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি), কেজিডিসিএল (কর্ণফূলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) ও এসজিসিএল’র (সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে না। কোম্পানিগুলো এখনই প্রচুর পরিমাণে মুনাফা করছে।
 
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের আইনগত ভিত্তি নেই। কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে মুনাফা করছে।

তিনি বলেন, পশ্চিমাঞ্চলের কর্মচারীরা ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং তিতাস গ্যাসের কর্মচারীরা প্রায় ২ লাখ ও কর্ণফুলির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পৌনে ৩ লাখ টাকা করে প্রফিট বোনাস পেয়েছেন। তাদের আরও কতো টাকা বোনাস দেবে?

শামসুল আলম বলেন, কোম্পানিগুলো ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ হচ্ছে। জনগণের ব্যয় আর না বাড়ানোর অনুরোধ করছি।

তিনি বলেন, গ্যাসের দাম কতো বাড়লো, সেই বিষয়টি বড় নয়। গ্যাসের দাম বাড়লো কি-না সেটাই বড় বিষয়। আজকে যদি গ্যাসের দাম এক টাকাও বাড়ানো হয়, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ও গাড়ি ভাড়া দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাবে। এ অরাজকতা কেউ ঠেকাতে পারবে না। দয়া করে সরকারকে বিপদে ফেলবেন না।

কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, এতোদিন গ্যাসের কোনো পণ্যমূল্য ছিল না। সরকার প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের পণ্যমূল্য নির্ধারণ করেছে ২৫ টাকা। যে কারণে দাম বাড়ানো প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে শামসুল আলম বলেন, এতোদিন যে ৫৫ শতাংশ হারে শুল্ক-ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছি সেগুলো তাহলে কি? এগুলো তাহলে কেন দিলাম?

শামসুল আলম বলেন, ২০০৩ সালে গ্যাসের মূল্যহার নির্ধারণের ফর্মুলা দিয়েছে সরকার। তাতে বলা হয়েছে, গ্যাসের ক্রয়/উৎপাদন মূল্য + সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় + সম্পুরক শুল্ক + মূল্য সংযোজন কর = ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য। এই ফর্মুলা বলবত রয়েছে।

গ্যাসের ক্রয়/উৎপাদন মূল্য, সঞ্চালন ও বিতরণ, সম্পুরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর বাড়েনি বা বাড়ানোর প্রস্তাবনা নেই সরকারের। সে কারণে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এ প্রস্তাবের আইনগত ভিত্তি নেই বলে দাবি করেন অধ্যাপক শামসুল আলম।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শুনানিতে অংশ নিয়ে আবাসিকে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সেই টাকা এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

শুনানিতে বিইআরসি এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো বলেছে, আবাসিকে ৮৭ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহারকে আদর্শ সীমা ধরে ৪৫০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু এ পরিমাণ গ্যাস আবাসিকে ব্যবহার হচ্ছে না। তাই সিস্টেম গেইন করছে গ্যাস কোম্পানিগুলো।

তাদের এ তথ্যের সূত্র ধরে একজন ভোক্তা বলেন, এখনই আবাসিকে বেশি টাকা আদায় করছে গ্যাস কোম্পানিগুলো। তাহলে আরও দাম বাড়ানো হবে কোন যুক্তিতে? প্রয়োজন হলে এলপি গ্যাসের দাম কমানো হোক।

গত ২ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া গণশুনানিতে কমিশন ও কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।
কোম্পানিগুলো ৫.২৪ থেকে ১২২.২২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। আবাসিকে (এক চুলা) ৪শ’ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা, দুই চুলা ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিদ্যুতে প্রতি হাজার ঘনমিটার গ্যাসের বর্তমান দর ৭৯.৮২ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮৪ টাকা, সার উৎপাদনে ৭২.৯২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১১৮.২৬ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, বাণিজ্যিকে ২৬৮.০৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫০ টাকা, চা বাগানে ১৬৫.৯১ থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা, সিএনজিতে ৮৪৯.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ১৩২.৬৭ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
 
তিতাস ২০১৩-১৪ অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট মুনাফা করেছে ১ হাজার ২৬ কোটি টাকা। তাদের কর্মচারীদের প্রফিট বোনাস দিয়েছে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো। দাম বাড়ালে সেই টাকা কর্মচারী ও ১৬ হাজার শেয়ারহোল্ডারের পকেটে চলে যাবে।

তিনি বলেন, ২০১২ সালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সময় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছিলো। তখন বলা হয়েছিলো, এ টাকা গ্যাস উত্তোলনের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই টাকা ৩ শতাংশ হারে সুদে খাটাচ্ছে পেট্রোবাংলা। আর সেই সুদের কারণে গ্যাসের উত্তোলন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

পেট্রোবাংলা এ কাজ করতে পারে না। তারা এ তহবিলের তছরূপ করছে। যারা এ ফান্ডের তছরূপ করেছে তাদের শাস্তি দিতে হবে। এই তহবিলের টাকার ওপর স্থিতিবস্থা জারি করার অনুরোধ জানান শামসুল আলম।

চার দিনব্যাপী এ গণশুনানি গ্রহণ করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান এ আর খান, সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন, রহমান মুরশেদ ও মাকসুদুল হক।
এর আগে গত ২১ জানুয়ারি থেকে চার দিনব্যাপী বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উপর গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রস্তাবিত পাইকারি দাম ১৮.১২ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বিবেচনায় ১৭ থেকে ২৫.৮৯ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলো। দু’টি বিতরণ সংস্থার সামান্য বৃদ্ধির সুপারিশ থাকলেও অন্যদের প্রস্তাব নাকচ করে  দিয়েছে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

পাইকারি দাম বাড়লে (প্রস্তাবিত ৫.১৬ শতাংশ) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ৭.৮৩ শতাংশ এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ২.২৮ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করে বিইআরসি। অন্যান্য কোম্পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই বলে মত দেয় কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। ওই শুনানির বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত এখনো দেওয়া হয়নি।

বিইআরসি কার্যালয়ে যখন গণশুনানি চলেছে ঠিক ভবনের বাইরে প্রায় প্রত্যেক দিনেই গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ও সিপিবি প্রতিবাদ হিসেবে গণঅবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০১৫

** তাহলে দাম বাড়ানোর সুর কেন?
** ‘তাহলে সরকার বিপদে পড়বে’
** আবাসিকে গ্যাসের দাম ১ হাজার টাকা করার প্রস্তাব
** পেট্রোবাংলা আতঙ্কিত !
** গ্যাসের হুইলিং চার্জ ৪৭ পয়সা করার প্রস্তাব

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।