ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

সৌর বিদ্যুতে আলোকিত প্রত্যন্ত গ্রাম শৈলখালী

জেসমিন পাপড়ি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
সৌর বিদ্যুতে আলোকিত প্রত্যন্ত গ্রাম শৈলখালী ছবি: কাশেম হারুণ/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সাতক্ষীরা থেকে: সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবশেষ উপজেলা শ্যামনগরের শৈলখালী গ্রাম। যাকে ছুঁয়ে গেছে বাংলাদেশ-ভারতকে বিভক্তকারী নদী কালিন্দী।

সীমান্তবর্তী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামটিতে পাকা রাস্তা নেই, নেই বিদ্যু‍ৎ সংযোগও। তবু সন্ধ্যা হলে গ্রাম আলো করে জ্বলে ওঠে বৈদ্যুতিক বাতি, যার শক্তি যোগায় সৌর বিদ্যু‍ৎ।

এই সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয় পুরো গ্রাম। তবে শুধু এই একটি গ্রাম নয়, উপকূলের প্রতিটি গ্রামই এখন সৌর বিদ্যুৎ নির্ভর। যেন তেলের কূপি এখন ‘হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও’ পাওয়া দায়।

শৈলখালী গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা, গৃহস্থালি ও রান্নার কাজ, ব্যবসা বাণিজ্য, দোকান-পাট চালানো এমনকি খেলাধুলাও চলছে সৌর বিদ্যুতের আলোর সাহায্যে। ঝলমলে সে আলো দেখে শহুরে যে কেউ একে বৈদ্যুতিক আলো বলে ভ‍ুল করতে পারেন।

ডুবে যাওয়ার আগে সূর্যের আলো গ্রামের প্রতিটি সোলার প্যানেলে রেখে যায় তার শক্তির কিছু অংশ। যা ব্যবহার করে গ্রামের পর গ্রাম হয়ে উঠছে আলোকিত।

রোববার (২২ নভেম্বর) বিকেলে শৈলখালী গ্রামে প্রবেশের পরপরই সূর্য ঢলে পড়লো পশ্চিমে। নামলো সন্ধ্যা। নানা দিকে থেকে ভেসে আসছিল মাগরিবের আজানের ধ্বনি। জানা গেলো, মসজিদে ব্যবহৃত মাইকগুলোও চলছে সৌরি বিদ্যুতে। অন্ধকার রাতে ঝিঁঝিপোকার ডাক পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই রাস্তার দু’পাশের মাটির বাড়িগুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরুচ্ছিলো।

একটি বাড়িতে প্রবেশ করতেই উঠানে একদল শিশু-কিশোরকে গোল হয়ে বসে পড়া-লেখা করতে দেখা গেলো। চেয়ারে বসে শিক্ষক তাদের পড়াচ্ছেন। সন্ধ্যার পর প্রতিদিন নিয়ম করে এখানে পড়ান তিনি।

আগে এসব শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে আলাদা হারিকেন বা তেলের কূপি আনা লাগতো। যে কূপি আনতে পারতো না সেদিন সে পড়তেও আসতো না। তবে এখন চিত্র বদলেছে। একটি আলোর নিচে বসেই সবাই পড়তে পারছে। আলাদা কূপির তেল কেনার খরচ না হওয়ায় দরিদ্র পরিবারগুলো যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।

সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় গ্রামের মোড়ে মোড়ে থাকা দোকানগুলো চোখে পড়লো। সেগুলোতেও জ্বলছে সৌর বিদ্যুতের আলো। দোকানদার আমিনুর ইসলাম খোকন জানালেন, এই গ্রামের দোকানগুলোতে একসময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো কোরোসিন তেল। যা দিয়ে হারিকেন বা মাটির কূপি জ্বালানো হতো।

আমিনুরের দোকানের একটি ঘরেই দেখা গেলো জমজমাট ক্যারাম খেলা চলছে, সেটাও সৌর বিদ্যুতের আলোয়।

জানা যায়, এক সময় এসব গ্রামে মোবাইল ফোনে চার্জ দিতে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে যাওয়া লাগতো। এখন প্রতি ঘরে ঘরেই মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়া সম্ভব। ফলে গ্রামে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীও বেড়েছে।

এ গ্রামের বাসিন্দা আবু তালেব বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকার কারণে বছরের পর বছর সরকারের সু-নজরের বাইরেই থাকি আমরা। রাস্তা-ঘাট খারাপ। বিদ্যু‍ৎ পর্যেন্ত আসেনি এখানে। তবু আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। এখানে যদি সরকার একটু নজর দিতো তাহলে আমাদের জীবনযাত্রা আরও উন্নত হতে পারতো।

জানা যায়, একটি ৫০ ওয়াটের সোলারের বাজার মূল্য প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু সোলার কোম্পানিগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিস্তিতে সোলার বিক্রি করে থাকে। তিন বছরে একটি সোলারের মূল্য পরিশোধ করতে লেগে যায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ মূল্য গুনতে হয় দরিদ্র মানুষগুলোকে। যা খুবই অমানবিক।

সরকারের সহায়তা পেলে আরও কমমূল্যে গ্রামের বাড়িগুলোর অন্ধকার দূর হতে পারে বলে মন্তব্য করেন আবু তালেব।

দেখা যায়, শুধু আলো জ্বালানো নয় টেলিভিশন, কম্পিউটারও চলছে সোলারের মাধ্যমে।

শৈলখালী দাখিল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক আবু সোহেল বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যেক স্কুলে একটি করে কম্পিউটার দিয়েছে সরকার। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ স্কুলে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে সেসব কম্পিউটার। সরকার কম্পিউটারের পাশাপাশি সেটা চালানোর জন্য যদি একটি করে সোলার প্যানেল দেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।

সোহেলের সঙ্গে এসব কথা বলে এগিয়ে যেতেই স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের মাঠে একদল প্রাণোচ্ছ্বল যুবককে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখা গেলো। অন্ধকার দূর করে সোলারের আলোয় দ‍ুর্দান্ত খেলে যাচ্ছেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৫
জেপি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।