ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

‘তারাবিতে পঠিতব্য আয়াতের তাফসির’

আজ ইসলাম পূর্ণ হওয়ার ঘোষণা পাঠ

মুফতি মাহফুযূল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৫
আজ ইসলাম পূর্ণ হওয়ার ঘোষণা পাঠ

আজ অনুষ্ঠিত হবে ৪র্থ তারাবি। আজকের তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে ৫ম পারার শেষ অর্ধেক এবং ৬ষ্ঠ পারা সম্পূর্ণ।

সূরা নিসার ৮৮নং আয়াত থেকে শুরু হয়ে সূরা শেষ হবে। এরপর সূরা মায়েদা শুরু কার হবে।

আজকের তারাবিতে সূরা নিসার অংশে তেলাওয়াতকৃত অংশের উল্লেখযোগ্য বিষয়াবলী হলো-

৯২নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, কোনো মুমিন যদি কোনো মুমিনকে বা কোনো জিম্মি, সন্ধিবদ্ধ কিংবা আশ্রিত অমুসলিমকে ভুলক্রমে হত্যা করে তবে সে একটি মুমিন কৃতদাস মুক্ত করবে এবং তার স্বজনরা নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের কাছে রক্তপণ পরিশোধ করবে। কোনো কারণে দাস মুক্ত করা সম্ভব না হলে একাধারে দু’মাস রোজা রাখবে। ‍

ইচ্ছাকৃত হত্যার দুনিয়াবি শাস্তি কিসাসের আলোচনা সূরা বাকারার ১৭৮নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর সূরা আন নিসার ৯৩নং আয়াতে ইচ্ছাকৃত হত্যার পরকালীন শস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যাকারী শাস্তিস্বরূপ অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। তার ওপর আল্লাহর গজব ও অভিশাপ বর্ষিত হবে। কঠিন শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নর হত্যাকারীর কোনো ক্ষমা নেই।

৯৪-১০০নং আয়াতে জিহাদ ও হিজরতের বিভিন্ন মাসয়লা আলোচনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুজাহিদদের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।

১০১নং আয়াতে সফর অবস্থায় নামাজ কসর করার বিধান দেয়া হয়েছে। জোহর, আসর ও এশার ফরজ নামাজ চার রাকাতের স্থলে দু’রাকাত পড়াকে কসর বলা হয়। ‍

১০২নং আয়াতে সালাতুল খাওফের বিধান দেয়া হয়েছে। ফিকাহবিদের মতে, সালাতুল খাওফের বিধান এখনো অব্যাহত রয়েছে, রহিত হয়নি। যুদ্ধের ময়দানে যেরূপ সালাতুল খাওফ পড়া জায়েজ, তেমনি যদি বাঘ-ভালুক কিংবা অজগর ইত্যাদির ভয় থাকে, তখনো সালাতুল খাওফ আদায় করা জায়েজ।

১০৫নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, কোরআন অবতীর্ণ করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো- কোরআনের আইন অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করা।

১০৬-১১২নং আয়াতে গুনাহগারকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

১১৫নং আয়াতে ওই ব্যক্তিকে জাহান্নামের ভীতি দেখানো হয়েছে, যে ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিরোধিতা করবে এবং মুসলিমদের পথ পরিহার করবে।

১১৬নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহতায়ালা শিরক ক্ষমা করবেন না। শিরক বলা হয়, আল্লাহকে মানার পাশাপাশি অন্যকিছুর পূজা করাকে। শিরক ব্যতীত অন্য যে কোনো গুনাহ আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু শিরকের গোনাহ তিনি ক্ষমা করবেন না।

১২৪নং আয়াতে আমলের প্রতিদান দেয়ার ব্যপারে আল্লাহর কাছে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই সেটা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ যেই ঈমান আনবে আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাত দান করবেন। ‍

১২৮নং আয়াতে স্বামী কর্তৃক উপেক্ষিত, অবহেলিত বা নির্যাতিত নারীকে আপোষের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সে নিজের খোরপোষ বা রাত্রী যাপনের অধিকার ছাড় দিয়ে আপোষের মাধ্যমে স্বামীর সঙ্গে নিজের বৈবাহিক সম্পর্ক ধরে রাখতে পারবে।

১৩০নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যার দুর্ব্যবহারে তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা যদি কঠিন হয়ে পড়বে সে যেন এ কথা মনে না করে যে, তাকে ছাড়া অপরজন এ দুনিয়াতে চলতে পারবে না। বরং সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর আল্লাহতায়ালা স্বীয় প্রাচুর্য হতে তাদের প্রত্যেককে স্বাবলম্বী করে দিবেন।

১৩৫নং আয়াতে স্বাক্ষ্য প্রদানকালে সত্যের ওপর অবিচল থাকাকে ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও স্বাক্ষ্য নিজের বিরুদ্ধে হয়, পিতা-মাতার বিরুদ্ধে হয়, আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে হয়।

১৩৯নং আয়াতে মুনাফিকদের একটি পরিচয় বলা হয়েছে। মুনাফিকরা ক্ষমতার স্বার্থে মুসলিমদের ছেড়ে অমুসলিমদের বন্ধু বানায়। অথচ আল্লাহতায়ালাই সকল ক্ষমতা ও সম্মানের মালিক।

১৪০নং আয়াতে দুর্বল অসহায় মুসলিমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন কাফের মুনাফিকদের কোনো সভাতে ততক্ষণ উপস্থিত না থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহর বিধি-বিধান নিয়ে উপহাস করে।

১৪২নং আয়াতে মুনাফিকদের পরিচয় দিতে যেয়ে বলা হয়েছে, ওরা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন খুব অলসতার সঙ্গে দাঁড়ায়। ওরা নামাজ পড়ে সুখ্যাতি অর্জনের মোহে। ওরা আল্লাহর জিকির করে না। করলেও খুব সামান্য জিকির করে।

১৪৪নং আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমরা মুমিনদের ছেড়ে কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।

সূরা আল মায়িদা
সূরা আল মায়িদা একটি মাদানি সূরা। এ সূরার মোট আয়াত সংখ্যা ১২০টি। আজকের তারাবিতে তেলাওয়াত করা হবে সূরা আল মায়িদার শুরু থেকে ৮২নং আয়াত পর্যন্ত।

২নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা নেক কাজে ও পরহেজগারীর কাজে একে অপরকে সাহায্য কর। গুনাহ ও নাফরমানির কাজে একে অপরকে সাহায্য করো না।

৩নং আয়াতে কয়েকটি হারাম জিনিসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- মৃতপ্রাণী, প্রবাহিত রক্ত, শোকরের গোশত, যে প্রাণীকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে খুশি করার জন্য জবাই করা হয়, শ্বাসরোধ করে হত্যা করা জন্তু, আঘাত করে হত্যা করা জন্তু, ওপর থেকে পতিত হয়ে মারা যাওয়া জন্তু, যে প্রাণীকে হারাম শরীফ ব্যতীত অন্য কোনো স্থানের সম্মানে জবাই করা হয়। এছাড়া টস্ করে কোনো কাজের শুভ-অশুভ নির্ণয় করাকে হারাম বলা হয়েছে এ আয়াতে।

এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক ইসলাম ধর্মকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ হওয়ার ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।

৬নং আয়াতে অজু ও তায়াম্মুমের বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ৮নং আয়াতে বিচার ব্যবস্থা ও স্বাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সত্য ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকার আদেশ করা হয়েছে। নিজ সম্প্রদায়ের লোক একথা ভেবে ন্যায় বিচার পরিহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।

২৭-৩১নং আয়াতে হাবিল-কাবিলের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে।

৩২নং আয়াতে উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল- বলে হত্যার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থানকে সুস্পষ্ট করেছে।

৩৮নং আয়াতে চুরির শাস্তি বিধান ঘোষণা করা হয়েছে হাত কাটা। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা হলো, চুরি করলেই ইসলামে হাত কেটে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত ধারণা। বরং হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি শর্ত রয়েছে।

সব চুরির ক্ষেত্রে ইসলামে হাত কাটার শাস্তি প্রযোজ্য নয়। অন্যের মাল হেফাজতকৃত ও সংরক্ষিত স্থান থেকে বিনা অনুমতিতে গোপনে নিয়ে যাওয়াকে ইসলামের পরিভাষায় চুরি বলা হয়। তাই শর্তের বেড়াজালে অনেক ক্ষেত্রেই চুরির ‘হদ’ জারি হয় না। যেমন ‘সংরক্ষিত স্থান’ শর্ত থাকায় সাধারণ জনসমাবেশের স্থান যেমন মসজিদ, ঈদগাহ, পার্ক, ক্লাব, স্টেশন, রেল, জাহাজ ও বিশ্রামাগারে রাখা মাল কেউ চুরি করলে তার হাত কাটা হবে না। গাছের ফল কিংবা মধু চুরি করলে হাত কাটা যাবে না। বরং রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে। একইভাবে নিজগৃহে প্রবেশের অনুমতিপ্রাপ্ত চাকর, রাজমিস্ত্রি কিংবা অন্তরঙ্গ বন্ধু ঘর থেকে কোনো কিছু নিয়ে গেলে তার হাত কাটা যাবে না। তবে তাকে অন্য শাস্তি দেওয়া যাবে। এমনিভাবে পকেট মারা, ছিনতাই করা, প্রতারণা করে অর্থসম্পদ হস্তগত করা কিংবা গচ্ছিত দ্রব্য অস্বীকার করা- সর্বসাধারণের পরিভাষায় চুরির অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের হাত কাটা হবে না; এবং তার সাজা বিচারকের বিচারাধীন। ঠিক তেমনি কেউ যদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত শরিকানাধীন মাল বা ব্যবসায়ে শরিকানাধীন মাল চুরি করে, তার হাত কাটা হবে না; অন্য দণ্ড প্রয়োগ করা হবে। এ ছাড়া দু’জন পুরুষের তাৎক্ষণিক সাক্ষ্য ব্যতীত ‘হদ’ জারি হবে না। অনুরূপভাবে ক্ষেতে বিদ্যমান ফসল যতক্ষণ ঘরে না উঠে, ততক্ষণ তা চুরি করলেও হাত কাটা যাবে না। সরকারি কোষাগার থেকে চুরি করলে হাত কাটা যাবে না। কেননা তাতে তারও অংশ রয়েছে। সন্দেহের উদ্রেক হলে শাস্তি মওকুফ হবে। ক্ষুধা ও অভাবের তাড়নাজনিত সন্দেহ, মালিকানায় অংশীদারিত্বের সন্দেহ স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর তা প্রত্যাহারজনিত সন্দেহ, এসব ধরনের সন্দেহের উদ্রেক হলেও ‘হদ’ জারি হবে না।

৫১নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা পরষ্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে তারাও তাদের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হবে।

৫২নং আয়াত থেকে চলতি পারার শেষ পর্যন্ত আয়াতে মুনাফিক, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কার্যকলাপ, তাদের ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদির সমালোচনা করে ইসলামের শ্বাশ্বত ও সুন্দর বিশ্বাস উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘন্টা, জুন ২১, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।