ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

সৌদি আরবে ইফতার করানো নিয়ে চলে নিরব প্রতিযোগিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৬ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৬
সৌদি আরবে ইফতার করানো নিয়ে চলে নিরব প্রতিযোগিতা ছবি: সংগৃহীত

বায়তুল্লাহ শরিফ ও মসজিদে নববীর দেশ এবং ইসলামি ঐতিহ্যের কেন্দ্রভূমি সৌদি আরবে রমজানে অপূর্ব আধ্যাত্মিক আবহের সৃষ্টি হয়। হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবে জন্মগ্রহণ করায় সংগত কারণে সেখানেই রোজা পালনের সূচনা ঘটে।

সেই ইতিহাস আমরা যতটা জানি, বর্তমান আরবদের সম্পর্কে আমরা জানি এর থেকে অনেক কম।

তেল সম্পদে ভরপুর সৌদিয়ানরা এক সময় ইফতারের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ত আর ভোরে ভোরে জেগে উঠত। কিন্তু আজ! আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যাপকহারে পাল্টে গেছে সৌদি আরবের জীবনচিত্র। এখনকার দিনে লোকজন সারারাত কিংবা প্রায় ভোর পর্যন্ত জেগে থাকে।
 
মাজহাবগতভাবে হাম্বলি ফিকাহের অনুসারী হওয়ায় সৌদি আরবই একমাত্র আরব দেশ, যেখানে প্রায় সব আলেম ও মুফতিরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে বেনামাজিকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাই এ দেশের প্রায় সব নাগরিকই নামাজ আদায় করেন।

সৌদি আরবে ইসলামের সুফিবাদী প্রথা তথা পীর-মুরিদির প্রচলন খুব কম। সৌদি আরবই সম্ভবত একমাত্র সেই দেশ, যেখানে ‘সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ সংস্থা’ নামে পুলিশের একটি বিভাগ রয়েছে, যাদেরকে মিডিয়ায় ‘ধর্মীয় পুলিশ’ ও জনসাধারণ ‘মুতাওয়েয়া’ বলে অভিহিত করা হয়।

পৃথিবীর আর সব অঞ্চলের মতো সৌদি আরবেও সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে খাদ্যাভ্যাস, সেই সঙ্গে ইফতারও। এখন সৌদির ইফতারে মূল উপাদান হিসেবে থাকে বিভিন্ন ধরনের মসলাদার খাবার; স্যুপ বা শরবতসহ কাবাব, ফাতির (রুটি), সবজি এবং হাসাইয়া আল-তুমেরিয়া বা খেজুর।

তবে ইফতারের ক্ষেত্রে তাদের কিছু পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন পরিবার প্রধান বা পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য প্রথম ইফতার করেন এবং তিনি অন্যদের হাতে ইফতার তুলে দেন। ইফতারির জন্য তারা খুব বেশি সময় ব্যয় করে না। মোয়াজ্জিন নামাজের জামাতের ইকামত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা খাবার ছেড়ে নামাজের জামাতে শরিক হয়। নামাজ শেষে তারা ইফতারের মূল পর্ব শুরু করে।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উল্লেখ্যযোগ্য যেসব দাওয়াতি ও সেবামূলক কাজ সম্পাদিত হচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বেশি অনুদান আসে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও আরব আমিরাত থেকে। রমজানে সৌদিতে এ ধারা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। রমজান আসার ১৫ দিন আগে থেকেই নবীর দেশে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়। রমজানকে ঘিরে চারদিকে পড়ে যায় সাজ সাজ রব। একে অন্যকে জানায় রমজানের অভিবাদন। দেখা সাক্ষাতে মানুষ রমজানের সওগাত জানায় ‘শাহরু আলাইকা মোবারাক’ বলে। রমজানকে ঘিরে দাওয়াতি কাজ শুরু করেন অনেকেই। বিভিন্ন রকমের হ্যান্ডবিল, লিফলেট, ছোট পুস্তিকা, সকাল-সন্ধ্যার দোয়ার ছোট কার্ড ইত্যাদি ছাপিয়ে মসজিদে মসজিদে বা ব্যক্তি পর্যায়ে বিতরণ করা হয়। আর এ ধারা অব্যাহত থাকে রমজানজুড়ে।

রমজানের আগে থেকেই এখানে সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় সারি সারি তাঁবু। এগুলো রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্য তৈরি করা হয়। আয়োজন করা হয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার। আর মসজিদগুলোতে থাকে ইফতারের ব্যবস্থা। কারখানার শ্রমিকরাও পান উন্নতমানের ইফতার সামগ্রী। রমজান উপলক্ষ্যে সরকারিভাবে কর্মঘণ্টা কিছুটা কমিয়ে দেওয়া হয়।

ইফতার সরবরাহ সওয়াবের কাজ। তাই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে মক্কা নগরীর হাজার-হাজার মানুষ ছাড়াও পবিত্র ওমরা করতে আসা বিশ্বের অগণিত মুসলমানরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতার সামগ্রী নিয়ে ছুটেন মসজিদে হারামে।

গত বছর থেকে নতুন নিয়মে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গনে ইফতারির আয়োজন করা হচ্ছে। যারা ইফতার সামগ্রী প্রদান করেন তারা সুপারভাইজার ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করবেন। তারা ইফতার সাজানো ও পরিষ্কারের দায়িত্ব পালন করবেন। মসজিদে হারামের প্রায় ৯০টি গেট দিয়ে রোজাদার মুসল্লিরা ধীরস্থীরভাবে প্রবেশ করছেন। সব ভোদাভেদ ভুলে এভাবে একসঙ্গে পাশাপাশি বসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে ইফতার গ্রহণের এ দৃশ্য বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না।

কাবার ইফতার আয়োজনে চেনা-জানার কোনো দরকার নেই, যাকে পাচ্ছে তাকেই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছে, ‘ভাই! আসুন আমরা একসঙ্গে একটু ইফতার করি। ’ এ ধরনের সম্বোধন করে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে রোজাদারদের নিয়ে যাওয়া হয় ইফতার আয়োজনে। কাবার ইফতারে থাকে না কোনো ভেদাভেদ।

সৌদি আরবে গত নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ওমরা মৌসুম। ওমরা পালনের জন্য গত সাত মাসে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ধ কোটি মানুষ দেশটিতে এসে পৌঁছেছেন। ওমরা পালনকারীদের এই সংখ্যা গতবছরের তুলনায় বেশি। ২৫ মে এক সরকারি পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে সৌদি গেজেট। তবে সৌদিয়ানরা রমজানের অর্ধেক অতিবাহিত হওয়ার পর ওমরা আদায়ে মনোযোগী হবেন এবং রমজানের শেষ দশকে হারামাইন শরিফে ইতিকাফের জন্য একত্রিত হবেন। এভাবেই ওমরা আদায় ও পূণ্য কাজের মাধ্যমে উৎসবমুখর পরিবেশে রমজানের সিয়াম পালন করেন নবীর দেশের নাগরিক ও অতিথিরা।

সৌদি আরবে অঞ্চলভেদে ঈদের অনুষ্ঠান ভিন্ন রকম হয়। তবে ঈদ উদযাপনে তাদের উদারতা ও আতিথেয়তা নজর কাড়ে। ঈদের নামাজ শেষে বাবার বাড়িতে জড়ো হয় সবাই। দুপুরে বিশেষ ভোজের আগে ছোটরা সালামির আশায় বড়দের সামনে গিয়ে ভিড় করে। এ সময় তাদের অর্থসহ বিভিন্ন জিনিস উপহার দেওয়া হয়।

ঈদের সময় অনেক দোকানি ক্রেতাদের বিভিন্ন জিনিস উপহার দিয়ে থাকেন। রাস্তাঘাটে পথচারীরা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এমনকি অনেক সময় অচেনা শিশুদের মঝে খেলনা ও বিভিন্ন ধরনের উপহার বিতরণ করা হয়। অনেক এলাকার অবস্থাসপন্ন অনেকে প্রচুর খাবার কিনে অসহায় দরিদ্র মানুষের দুয়ারে দিয়ে আসেন গোপনে।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘন্টা, জুন ১৬, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।