রমজান মাসের রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহমুখি মানুষ ও আল্লাহমুখি অন্তর তৈরি করা। সারা বছর নানাবিধ পার্থিব ধারণা ও মোহে আচ্ছন্ন মানুষের কুমন্ত্রণা, পাপাচারমূলক কাজের অনুভূতিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে রমজান ব্যক্তির নৈতিক সত্তা ও চরিত্রকে ঈমানের আলোয় আলোকিত করে।
হাজারো মহিমায় উদ্ভাসিত পবিত্রতম এ মাসে মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ইসলামি শরিয়া বিরোধী প্রচলিত এমন কিছু কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে যায়, যা রমজান মাসের মর্যাদা ও পরিত্রতাকে ক্ষুন্ন করে। প্রকৃত মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো রমজান মাসে সিয়াম পালনের পাশাপাশি প্রচলিত ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং এসব বিষয় সম্পর্কে অপরকে নিরুৎসাহিত করা।
রমজান মাসে মানুষের পক্ষ থেকে সম্পাদিত প্রচলিত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
রমজানকে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করা
অনেকে রমজানকে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশপাশের লোকজন রোজাদার বলে সম্বোধন করবে, অনেকটা লৌকিকতার উদ্দেশ্যেই সিয়াম পালন করছি। আমরা ভুলে যাই, এ সিয়াম সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে ভুলে যাই, ভুলে যাই জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তির এ দূর্লভ সুযোগকে।
বিলম্বে ইফতার করা
কেউ কেউ সূর্যাস্তের পরও অধিক সতর্কতার অজুহাতে বিলম্বে ইফতার করে। সুন্নত হলো, রোজাদার ওয়াক্ত প্রবেশ নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার গ্রহণ করবে। হজরত সাহল ইবনে সাদ আস-সায়েদি (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ততদিন যাবত মানুষ কল্যাণে থাকবে যতদিন তারা ইফতার আগেভাগে বা তরান্বিত করবে। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
রোজা রাখা কিন্তু নামাজ আদায় না করা
অনেকে রোজা পালন করেনম কিন্তু নামাজ আদায় করেন না। এটা কাম্য নয়। হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নামাজ হচ্ছে ঈমান এবং কুফরের পার্থক্যকারী। ’ –সহিহ মুসলিম
রাতে জাগা ও নিদ্রায় দিন অতিবাহিত করা
অনেকে এ অভ্যাসের কারণে রোজার বিভিন্ন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। কখনও কখনও এর কারণে জামাতের সঙ্গে নামাজ ছুটে যায় বা নামাজের সময়ও পার হয়ে যায়।
খাদ্য-পানীয় গ্রহণে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করা
পরিমিতবোধ সব কিছুর চাবিকাঠি। অনেক মানুষের নিকট রমজান মাস খানা-পিনা গ্রহণ প্রতিযোগিতার মওসুমে পরিণত হয়। যদিও রমজান মাস গরিব-দুঃখীর অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট অনুধাবনের। অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ একজন মানুষকে আবশ্যকীয় অনেক আমল ও ইবাদত হতে দূরে সরিয়ে নেয়, মানুষকে করে তোলে অলস এবং অন্তরকে করে ফেলে বধির।
স্বাস্থ্য কমানোর লক্ষ্যে রোজা রাখা
প্রত্যেকটি কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। রোজা পালনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। স্বাস্থ্য কমানোর জন্য অনেকেই রোজা পালন করেন, এটা কাম্য নয়। যদি কেউ এ উদ্দেশ্যে রোজা পালন করেন, তাহলে তা হবে গোনাহের কারণ।
রোজা রাখা অথচ খারাপ কাজ বর্জন না করা
অনেক রোজাদার রোজা রাখেন কিন্তু মিথ্যাচার, গীবত, পরনিন্দা, চোগলখোরি, মারামারি ইত্যাদি পরিত্যাগ করতে ব্যর্থ হন। রোজা রাখার উদ্দেশ্য কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকা নয় বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকল প্রকার অনাচার, পাপাচার, অশ্লীলতা, হারামকার্য, খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তাকে পূতপবিত্র করা। হরজত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সিয়ামরত অবস্থায় মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। ’ –সহিহ বোখারি
রোগীর কষ্ট হওয়া সত্বেও রোজায় অটল থাকা
আল্লাহতায়ালা বান্দার ওপর তার সামর্থ্যরে বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। কোনো রোগীর কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাকে সিয়াম পালন করতে হবে এটা মহান রবের বিধান হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোজা ভঙ্গ করা ও পরবর্তীতে তা কাজা করার অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। ’ -সূরা আল বাকারা: ১৮৫
মুসাফিরের জন্য রোজা ভঙ্গ করা ত্রুটি মনে করা
মুসাফিরের জন্য রোজা রাখার বিধানটি তার ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে সে রোজা রাখবে অথবা সে রোজা ভেঙে ফেলবে। এটি মুসাফিরের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে রোজা ত্যাগ করা
পরীক্ষা বা কর্মব্যস্ততার কারণে সিয়াম ত্যাগ করা শরীয়তসিদ্ধ নয়। আমাদের স্মরণে থাকা উচিত, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল যেমন মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয় তেমনি মানুষের কর্মস্থলের কর্মতৎপরতায় সহজ ও সুচারুপে সম্পাদনের একমাত্র মালিক হলেন মহান রব নিজেই। সুতরাং পরীক্ষা ও কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সিয়াম ত্যাগ না করে তার সাহায্য ও রহমতের প্রত্যাশী হয়ে সিয়াম পালন করা আমাদের কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। ’ -সূরা তালাক: ৩
রোজাদার ভুলবশত খেয়ে ফেললে রোজা ভেঙে গেছে ধারণা করা
রোজাদার ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেললে অথবা পান করে ফেললে রোজা ভেঙে গেছে ধারণা করা। যে ধারণাটি সঠিক নয়। কেননা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমাদের মধ্যে কেউ ভুলক্রমে কিছু খেয়ে বা পান করে ফেলে সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে কেননা তাকে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে খাওয়ানো ও পান করানো হয়েছে। ’ –সহিহ বোখারি
তারাবির নামাজ আদায়ে অনীহা
অনেক রোজাদারের মধ্যে তারাবির নামাজ আদায়ে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। তারা তারাবি আদায় না করে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থেকে মূল্যবান এ সময়কে অতিবাহিত করেন, যা বড় ধরনের পাপ।
রোজার রাতে স্ত্রীগমন হারাম মনে করা
বস্তুত দিনের বেলায় রোজা থাকাবস্থায় স্ত্রীগমন নিষিদ্ধ। কিন্তু রাতে স্ত্রীগমন হারাম নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য রোজার রাতে স্ত্রীগমন হালাল করা হয়েছে, তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। ’ -সূরা বাকারা: ১৮৭
দোয়া কবুল হওয়ার সুযোগগুলো ছেড়ে দেয়া
সিয়াম পালনকারীর দোয়া মহান আল্লাহতায়ালা কবুল করে থাকেন। আমাদের কেউ কেউ এ সময়ে দোয়া না করে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, দুনিয়াবী কাজ-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমাদের অসর্তকর্তার কারণে দোয়া কবুলের এ মহৎসুযোগগুলো আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, ১. পিতার দোয়া, ২. রোজাদারের দোয়া ও ৩. মুসাফিরের দোয়া। ’ -আহমাদ
ঈদের প্রস্তুতির জন্য শেষ দশককে অবহেলায় কাটানো
অনেকেই ঈদের কেনাকাটা নিয়ে মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে রমজানের শেষ দশকের দিনগুলো অবহেলায় অতিবাহিত করে থাকেন। যথাযথভাবে ইবাদত না করে বা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ না করে মার্কেটিং এ ব্যস্ত থাকা কাম্য নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে আল্লাহর ইবাদতে খুব বেশি সময় নিমগ্ন থাকতেন। রমজান শুরু হওয়ার পূর্বেই আমাদের কেনাকাটা শেষ করা উচিত। হজরত আয়েশা (রা) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক শুরু হতো, রাসূল (সা.) লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং তার পরিবারকে জাগিয়ে তুলতেন। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
রমজান মাসকে যথার্থ গুরুত্ব না দেওয়া
অনেক রোজাদার এ মহামূল্যবান মৌসুমকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। আমাদের উচিত, এ পবিত্র মাসের প্রতিটি সময়, ক্ষণ, মুহূর্ত মহান রবের ইবাদতে কাটানো, যাতে এ মাসের সর্বোচ্চ সওয়ব হাসিল করতে পারি। অত্যন্ত মূল্যবান এ মাসকে যাতে আমরা অবহেলা না করে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করতে পারি।
রমজান মাসের যেমন রয়েছে অজস্র ফজিলাত তেমন রয়েছে এ মাসের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার মাহাত্ম। বছরের সবচেয়ে পবিত্রতম মাস জানা সত্ত্বেও আমরা এমন কিছু ভুল ও অন্যায় করে ফেলি যা রমজান মাসের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এ ভুল-ভ্রান্তি থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মহান রবের নৈকট্য লাভে মাসব্যাপী একনিষ্ঠভাবে রোজা পালন, তারাবি আদায়, অপরকে ইফতার করানো, তাহাজ্জুদ আদায়, বেশি বেশি নফল ইবাদত পালন, নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত, বেশি বেশি ইসতেগফার করা, দোয়া, জিকির-আজকার, দান-সদকাহসহ নানাবিধ আমলের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টা করাই হবে রমজান মাসের মূল অঙ্গীকার। প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তি নিজে পরিহার করে অন্যকে সেবিষয়ে সচেতন করাই হবে একজন মুমিনের দায়িত্বও কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা আমাদের তওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৬
এমএইউ/