চাঁদপুর: গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন আব্দুল্লাহ কবির। তার নামে ছিল ৩০-৪০টি রাজনৈতিক মামলা।
বিগত ১৫ বছর ধরে এতোগুলো মামলার কারণে পলাতক জীবনযাপন করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আব্দুল্লাহ কবির। তার স্বপ্ন ছিল, নিজের একমাত্র ছেলেকে পবিত্র কোরআনে হাফেজ বানানোর।
ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করায় তার নামে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে এসব মামলা হয়। যে কারণে তিনি নিজের বাড়িতে থাকতে পারতেন না। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজধানীর ১১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন বলে জানান তার ছোট ভাই রাজু।
সম্প্রতি শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের নানা বাড়ি সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকর্দি খাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সমাহিত করা হয়েছে শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরকে।
মৃত মোসলেহ উদ্দিন খানের ছেলে মো. আব্দুল্লাহ কবিরের জন্ম হয় ১৯৭৮ সালের ১১ নভেম্বর। মা সুরাইয়া বেগমের বয়স ৭২। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে কবির চতুর্থ। সবার বড় বোন রত্না বেগম (৫৫), হীরা বেগম (৫০) মুক্তা বেগম (৪৮), রুমি (৪২) ও ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু (৪০)। শহীদ কবিরের জন্ম স্থান চাঁদপুরের মতলব পৌরসভার বড়দিয়া আড়ং গ্রামের খান বাড়িতে।
তবে নদী ভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হওয়ায় তাদের বর্তমান ঠিকানা রাজধানীর মিরপুর মধ্য পাইকপাড়ার বাড়ি নম্বর ১০৭, মধ্য পাইকপাড়া গবেষণাগার সড়ক, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। শহীদ কবিরের বোনেরা গৃহিনী। একমাত্র ছোট ভাই মিরপুরে স্টক লটের (গার্মেন্টস পণ্য) ব্যবসা করেন।
শহীদ আব্দুল্লাহ কবির ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পাস করেছেন ঢাকার ধামরাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। মিরপুর কমার্শিয়াল কলেজ থেকে ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৯৬ সালে ঢাকা মোহাম্মদপুর নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে বিএ ভর্তি হয়ে কিছুদিন পর লেখাপড়া বাদ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ও তার ছোট ভাই মিরপুরে স্টক লটের (গার্মেন্টস পণ্য) ব্যবসা করতেন।
২০১২ সালে আফসানা আক্তারকে (৪০) বিয়ে করেন কবির। তাদের একমাত্র সন্তান হচ্ছে আহনাফ খান (৯)। স্থানীয় মারকাজুল ফয়েজুল কুরআন আল-ইসলামিয়া মাদরাসায় হিফজুল কুরআন বিভাগে পড়ছে আহনাফ।
আফসানার বাবার বাড়ি মতলব দক্ষিণ উপজেলার সদরের কলাদি টিঅ্যান্ডটি মোড়ে।
শহীদ কবিরের ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু জানান, ঘটনার দিন ৪ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে কবির ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য ব্যাংকে যান। সেখান থেকে সাড়ে ১০টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বেলা আড়াইটার দিকে কবিরের ফোন থেকে তার স্ত্রীকে কেউ কল দিয়ে ম্যাক্স হাসপাতালে যেতে বলেন। তখন তিনি সেখানে গেলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। পরে কবিরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে না পেরে আফসানা চলে যান ইসলামিয়া হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসা না পেয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। পরে ওই হাসপাতালে কবিরের মৃত্যু হয়।
তিনি আরও জানান, কবিরের মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত করার কথা বলে। কিন্তু আন্দোলন ও ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ লাশ নেয়নি। সবশেষ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর বেলা ২টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ কবিরের পরিবারকে ডেকে ছাড়পত্র দিয়ে লাশ হস্তান্তর করে।
ওই দিন রাতেই রওনা দিয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকার্দি গ্রামে নানা বাড়িতে লাশ নেওয়া হয়। কারণ তখন কবিরের নানাবাড়িতে তার মা উপস্থিত ছিলেন। মায়ের অনুরোধে পরদিন ৬ আগস্ট সকালে নামাজে জানাজা শেষে নানাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে কবিরকে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার গেল বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার আবেদন করেন। আবেদনটি বিচারক আমলে নিয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার নির্দেশ দেন।
ওই মামলায় বাদী ৬৮ জনকে নামীয় আসামি করে মামলা করেন। মামলার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান কবিরের স্বজনরা।
শহীদ কবিরের ছোট ভাই রাজু আরও বলেন, আমার ভাই রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে সব সময় হয়রানির শিকার হতেন। তিনি ৪০ থেকে ৪৫টি রাজনৈতিক মামলার আসামি ছিলেন। এমনও হয়েছে, ভাইকে আমাদের ব্যবসায়িক ঠিকানায় না পেয়ে পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে গেছে। প্রথম বার ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ নিয়ে গেলে দেড় মাস এবং ২০১৫ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে গেলে সাড়ে সাত মাস কারাভোগ করতে হয় আমাকে। তবে আমি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী না। আমি ভাইয়ের এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার বলেন, ২০১২ সালে আমার সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তিনি মামলার কারণে ঠিকমতো বাড়িতে থাকতে পারতেন না। বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে থাকতেন এবং পরিবারের সদস্যদেরও সময় দিতে পারতেন না। তিনি যেদিন শহীদ হন, সেদিন তার গায়ে জ্বর ছিল ১০২ ডিগ্রি। আমি ওনাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও আমার কথা শোনেননি। তিনি এভাবে আন্দোলনে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে আমাদের কি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখার কথা বলতেন এবং ছেলেকে হাফেজে কোরআন বানাতে বলতেন।
তিনি আরও বলেন, স্বামী শহীদ হওয়ার পর তার ব্যবসা বন্ধ। সন্তানকে নিয়ে দারুস্সালাম এলাকায় বর্ধন বাড়ির একটি বাসায় ভাড়া থাকি। কিন্তু এখন খুবই অর্থ কষ্টে আছি। সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে একটি চাকরি দিলে সন্তানকে নিয়ে কোনো রকম বেঁচে থাকতে পারতাম।
আফসানা আক্তার জানান, এ পর্যন্ত সরকারি অনুদান হিসেবে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে মোট পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছেন তারা। তার মধ্যে চার লাখ তিনি ও তার ছেলে এবং এক লাখ টাকা শ্বাশুড়ি পেয়েছেন। এছাড়া ঢাকায় জামায়াতের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আবেদন করেছেন, সেখান থেকে এখনও কোনো অনুদান পাওয়া যায়নি। তবে আব্দুল্লাহ কবিরের নাম তালিকায় ৫৬ নম্বর গ্যাজেট হয়েছে চাঁদপুর জেলার ঠিকানায়। .jpg)
শহীদ কবিরের ছোট বোন রুবি থাকেন মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায়। সেখানে তার সঙ্গে থাকেন শহীদ আব্দুল্লা কবিরের মা সুরাইয়া বেগম।
রুবি বলেন, ভাই শহীদ হওয়ার পর থেকে ভাবি আলাদা থাকছেন। ভাই আগে থেকেই মায়ের চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ দিতেন। যা এখন বন্ধ হয়ে আছে। আমি পরের ঘরে থাকি। এ অবস্থায় মাকে তার চাহিদামতো সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না।
শহীদ আব্দুল্লাহ কবিরের মা সুরাইয়া বেগম বলেন, আন্দোলনের সময় আমি আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম। ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয় ৩০ ও ৩১ জুলাই। আন্দোলনের সময় ছেলের সাথের লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এসব খবর শুনে খুবই মন খারাপ। তখন থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্তু আমাদের কারো নিষেধ শোনে নাই। আন্দোলনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ছেলে আমার প্রাণ হারায়।
তিনি বলেন, আমার অন্য সন্তানদের চাইতে কবিরই বেশি খোঁজ নিত। ছেলে আমার রাজনৈতিক মামলার কারণে ঠিকমতো বাড়িতে থাকতে পারেনি। তারপরও গোপনে এসে আমার খোঁজ খবর নিত এবং আমার ওষুধ কিনে দিত। ছেলেকে হারিয়ে আমি এখন খুবই অসহায়। আজ কতদিন আমার বাপরে দেখি না, আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে না। এখন সরকারের সহযোগিতা চাই, আমার নিজের চলার মতো অবস্থাও নেই, তাই সরকারি আর্থিক সহায়তা দরকার আমার আর আমার নাতি ও পুত্রবধূর জন্য।
এসআই


