চাঁদপুর: বাবাকে আর কখনো ফিরে পাব না। বারবারই বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতির কথা মনে পড়ে।
এ সময় শহীদ মিজানুর রহমানের ছেলে রবিউল আলম বলেন, বাবা ঢাকায় থাকলেও সব সময় আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি মৃত্যুর আগেও ওইদিন সকালে আমাকে ফোন দিয়েছেন। বাবা বলেছেন বাড়ির বাজার করে দিতে। এরপর আর কথা হয়নি। আমাদের পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে আমাকেই কাজে যোগ দিতে হবে। আমি চাই সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়।
রাজধানীর নর্দা এলাকায় ওমেন ওয়ার্ল্ড নামে কোম্পানিতে পার্লারের মেডিসিন তৈরির কাজ করতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে শহীদ মো. মিজানুর রহমান। তিনি গত বছর ২১ জুলাই বিকেলে মসজিদ থেকে আসরের নামাজ পড়ে বের হলে আজিজ সড়কের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
তিনিই ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী। মৃত্যুর পর খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে এ শহীদ পরিবার। স্ত্রী ঝর্ণা বেগম দুই সন্তান নিয়ে বর্তমান থাকেন চাঁদপুর শহরের রহমতপুর আবাাসিক এলাকায় বোনের বাসায়।
শহীদ মিজান চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি দক্ষিণ ইউনিয়নের পিংড়া গ্রামের তপাদার বাড়ির মৃত মো. খলিলুর রহমানের ছেলে।
সম্প্রতি মিজানুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আত্মীয় স্বজন ও তার স্ত্রী ঝর্ণা বেগমের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওই বাড়ির বাসিন্দা আব্দুল গফুর তপাদার জানান, শহীদ মিজানরা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বর্তমানে দুই ভাই জীবিত আছেন। সোলেমান নামে একজন বাড়িতে থাকেন। তিনি কৃষি কাজ করেন। আরেক ভাই সিরাজুল ইসলাম তিনি অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মেজর। তিনি সপরিবারে ঢাকায় থাকেন।
মিজানের চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান জানান, মিজানুর রহমান খুবই নিরিবিলি থাকতেন। তবে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসলে বাড়ির লোকদের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি শহীদ হওয়ার পরে এলাকার লোকজনের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। তবে ওই সময় দেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, মিজানুর রহমান এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং স্ত্রী রেখে গেছেন। তার বসতঘরটির অবস্থা খুবই নাজুক। অনেকটা বসবাসের অযোগ্য। যে কারণে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান চাঁদপুর শহরে বোনের বাসায় থাকেন। অন্যের সহযোগিতায় কতদিন তাদের পরিবার চলবে। আমরা চাই সরকার এ পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
শহীদ মিজানের স্ত্রী ঝর্ণা বেগম বলেন, ২১ জুলাই সন্ধ্যায় আমার স্বামীর কোম্পানির এক লোক তার মৃত্যুর সংবাদ ফোন করে জানায়। তখন আমরা বাড়িতে। আসরের পর তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে বারিধারা জেনারেল হসপিটালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এরপর আমার স্বামীর বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। ২২ জুলাই সকালে বাড়ির সামনের আঙ্গিনায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন হয়।
তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে এখন পর্যন্ত খুবই অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছি। মেয়ে এখনো বাবার ফোনের অপেক্ষায় থাকে। জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ টাকা এবং মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে লোক মারফতে ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি।
শহীদ মিজানের ছেলে রবিউল আলম পিয়াস (১৮) শহরের পুরাণ বাজার ডিগ্রি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে এবং মেয়ে ফারজানা আক্তার গ্রাম এলাকার শাহজালাল উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে। সে ২০২৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো উপায় না পেয়ে ছেলের পড়ালেখার সুবিধার্থে বোনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান ঝর্ণা বেগম।
ঝর্ণা বেগম আরো বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। সন্তানদের পড়া লেখার খরচ ও সংসার চালানো খুবই কঠিন। সরকার যদি আমার ছেলেকে কোনো ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাহলে আমাদের কোনো রকম গতি হবে। আমি সরকারের কাছে বাড়িতে একটি বসতঘর নির্মাণ ও সন্তানের কর্মসংস্থানের দাবি জানাচ্ছি।
জেএইচ