ঢাকা, সোমবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০৯ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

গণঅভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জ ট্রাজেডি: এক দিনে ঝরেছিল ছয় প্রাণ 

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:২৫, আগস্ট ৪, ২০২৫
গণঅভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জ ট্রাজেডি: এক দিনে ঝরেছিল ছয় প্রাণ 

সিলেট: ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। দিনটি সিলেটবাসীর জন্য ভয়ঙ্কর এবং মর্মান্তিক।

এদিন ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে ঘটে ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি। এদিন দুপুরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছাত্র-জনতা নেমে আসে রাজপথে।

গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ ডিগ্রি কলেজের সামনে থেকে ছাত্র-জনতা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের সরিয়ে দিতে বল প্রয়োগ করে পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। আন্দোলনরত ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিভিন্ন মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হয়। এলাকাবাসী ছাত্রদের সঙ্গে নেমে আসেন রাজপথে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় তুমুল সংঘর্ষ।  

উপজেলার ধারাবহর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ-বিজিবি সদস্যরা জনতার দিকে গুলি, টিয়ার সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ গোলাপগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। জনতার ধাওয়ায় পুলিশ ও বিজিবি পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু এরইমধ্যে গুলিতে ঝরে পড়ে তাজা ছয় প্রাণ। নিহতরা হলেন, নাজমুল ইসলাম, দর্জি কারিগর জয় আহমদ, রাজমিস্ত্রি সানি আহমদ, ক্বারী কামরুল ইসলাম পাবেল। একই দিন দুপুরে গোলাপগঞ্জ পৌরসভার সন্নিকটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে নিহত হন সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক গৌছ উদ্দিন এবং মেকানিক মিনহাজ আহমদ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। গুলিতে ও সংঘর্ষে আহত হন অন্তত শতাধিক। ওইদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহতদের লাশ নিয়ে পৌরশহরে বিক্ষোভ মিছিল করেন স্থানীয় এলাকাবাসী। এ আন্দোলনে সিলেটে একদিনে এতো বেশি নিহতের ঘটনা আর কোথাও ঘটেনি।  

ওইদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে গোলাপগঞ্জের ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া ছাড়াও গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকশ ছাত্র-জনতা মারাত্মক আহত হন। চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রিয়জনের চিরবিদায়ের দৃশ্য দেখতে হবে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। তাছাড়া আহতদের অনেককে হারাতে হয়েছে চোখের দৃষ্টি, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং শারীরিক সক্ষমতা। এমন দুর্বিষহ ঘটনায় সমগ্র সিলেটের এমনকি দেশের মানুষকেও হতবাক করেছে।  

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে গোলাপগঞ্জবাসী বিষাদময় এক ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে রইলো।  

গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। পরে গোলাপগঞ্জের হতাহতের ঘটনায় হত্যা, বিস্ফোরকসহ প্রায় ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়। তন্মধ্যে সাতটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় প্রায় ৫০০ জনের অধিক মানুষের নামোল্লেখ করে এবং আট শতাধিকের বেশি আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার হন ১৩৪ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত কোনো মামলার চার্জশিটের প্রতিবেদন  আদালতে দাখিল করা হয়নি।  

গোলাপগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোল্যা মো. মনির হোসেন বলেন, হত্যা মামলাগুলোর দুটি থানায়, দুটি পিবিআই এবং আরও দুটি সিআইডির কাছে তদন্তাধীন রয়েছে।  

সিআইডির পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা বলেন, গোলাপগঞ্জের তিনটি হত্যা মামলা সিআইডিতে রয়েছে। মামলাগুলো বৈজ্ঞানিক ও ম্যানুয়ালি, উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ে তদন্ত চলছে। ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে অডিও, ভিডিও এবং অন্যান্য প্রমাণগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করে অগ্রসর হচ্ছি।  

গত বছরের এদিনটিতে সিলেটে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর বল প্রয়োগ করে পুলিশ। গত বছরের ৪ আগস্ট দুপুরে আন্দোলনকারীরা নগরের কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হলে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল ও শর্টগানের গুলি নিক্ষেপ করে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। এরপর বিকেল ৫টা থেকে থেমে থেমে রাত ৮টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমনে বিপুল পরিমাণ টিয়ারশেল, শর্টগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হয়।  

এর আগের ৩ আগস্ট দুপুর ২টা থেকে আন্দোলনকারীরা চৌহাট্টা ও জিন্দাবাজার পয়েন্ট অবরোধ করে রাখেন। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে আম্বরখানা সড়কের দিক থেকে চৌহাট্টা পয়েন্টে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও শর্টগানের গুলি নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় পুলিশ সদস্যরা মীরবক্সটুলা, তাতিপাড়া, কাজি ইলিয়াস, হাওয়াপাড়া এলাকায় আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করে টিয়ারশেল, শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে। কিছু সময়ের জন্য আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হলেও ফের নগরের জিন্দাবাজার পয়েন্টে জড়ো হয়ে আন্দোলন শুরু করে। এভাবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওইদিন পুলিশের ছোড়া শর্টগানের গুলিতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হন।

এনইউ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।