মৌলভীবাজার: বছর ঘুরে ফের হাজির দুঃশাসন আর নারকীয় সব ঘটনার সাক্ষী সেই ৪ আগস্ট। এদিন রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরসহ দেশের ৬৪টি জেলা জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ফ্যাসিবাদ পতনের একদফা দাবিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে।
১৭ জুলাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে শহরের শাকুরা মার্কেটের সামনে ছাত্রলীগ পুলিশের সামনেই শিক্ষার্থীদের ওপর লাটিসোঠা ও হকিস্টিক দিয়ে বেপরোয়া হামলা চালায়। আহত হন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। ওই দিনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আহত হন আব্দুস সালাম নামে এক আন্দোলনকারী। এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতেও আন্দোলন অব্যাহত রাখেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
সে সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় আর আওয়ামী লীগের ক্ষমতাধর নেতাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধিরে ধিরে প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিও বাড়তে থাকে শহরের রাজপথে। আন্দোলনের পরিধি যত বাড়তে থাকে ততই আওয়ামী লীগ,ছাত্রলীগ,যুবলীগসহ তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্দয় ও আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, রোববার। দুপুর ১২টা। মৌলভীবাজারের রাজপথে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ সহযোগী সংঘঠনের নেতাকর্মীদের সংগঠিত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র মহড়া আর নৃশংস হামলার কারণে চিরায়ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পতন ঘটে শান্ত এ শহরে। এতে বিক্ষোব্ধ ও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে জনতা। আন্দোলনের ঢেউ শুধু মৌলভীবাজার শহরেই নয়, একই সঙ্গে জেলার ৭টি উপজেলাও ছড়িয়ে পড়ে জনতার বিস্ফোরণ।
শহরমুখী জনতার স্রোত এসে মিলিত হয় চৌমুহনা চত্বরে। সেদিন এ স্থানটি হয়ে উঠে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। এদিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে কর্মসূচি হলেও ফ্যসিবাদ বিরোধী সব মত-পথের নিপীড়িত জনতা মাথায় লাল সবুজের পতাকা আর নানা প্রতিবাদী শ্লোগান সস্বলিত প্লেকার্ড সঙ্গে নিয়ে শহরের অলিগলিতে আন্দোলনে যোগ দিতে বেড়িয়ে পড়েন জীবনের মায়া ছেড়ে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১২টায় শহরের সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি চৌমুহনী পয়েন্টে আশা মাত্রই তৎকালীন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে হামলা চালায়। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একত্র হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।
এসময় শিক্ষার্থীরা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে এবং সাইফুর রহমান সড়ক, শমসেরনগর সড়ক ও চাঁদনীঘাট সড়কে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এদিন শহরের চৌমুহনা,সমশেরনগর সড়ক, সাইফুর রহমান সড়কে আন্দোলনকারীদের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন।
পাশাপাশি ৮ জন সাংবাদিকও আহত হন। ভাঙচুর করা হয় ক্যামেরা ও সাইকেল। শুরু থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখলেও বিকেল ৩টার দিকে অ্যাকশনে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড মেরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় পুলিশ শহরের সেন্ট্রাল রোড, কোর্ট রোড, শমসেরনগর রোড ও চাঁদনীঘাট রোডে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় মার্কেট, শপিংমল, বিপণী বিতানসহ শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আর চরম আতঙ্ক। সন্ধ্যার পর পুরো শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ। উদ্বেগ আর চরম আতঙ্ক নিয়ে শহরের রাজপথ ফাঁকা হয়ে যায়। তবে চিহ্ন রেখে যায় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ক্ষতচিহ্ন। ৪ আগস্ট ছিল নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মৌলভীবাজার জেলা শহরে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় গণআন্দোলন।
বিবিবি/জেএইচ