ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেই ফিরবে বলেছিল, এলো লাশ হয়ে

ইমতিয়াজ আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪১, আগস্ট ৫, ২০২৫
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেই ফিরবে বলেছিল, এলো লাশ হয়ে মা মনিকা, বাবা স্বপন কুমার দে ইনসেটে দীপ্ত দে

জুলাই গণ অভ্যুত্থান। পেরিয়ে গেল এক বছর।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন মাদারীপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দীপ্ত দে। এরপর আর মায়ের হাতে মাখানো ভাত খাওয়া হয়নি তার। ভাত খেতে বসলেই দীপ্তর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মা মনিকা দে! 

জানা গেছে, দীপ্তর বাবা স্বপন কুমার দে মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা। সেই সুবাধে মাদারীপুরে বসবাস তাদের। পৈতৃক বাড়ি ভোলা জেলায়। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন শহরের আমিরাবাদ এলাকায় ভাড়া বাসায় ছিলেন। দীপ্তর মৃত্যুর পর তারা শহরের জেলা পরিষদ সংলগ্ন হারুন সড়কে একটি বাসায় চলে গেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে দীপ্ত ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই হেমন্ত দে (১৯) মেডিকেল ভর্তি কোচিং করেন ঢাকায়।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যান দীপ্ত। মাদারীপুর শহরে আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাদারীপুর সরকারি কলেজের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।

১৮ জুলাই সকালে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয় এবং তাদের লাঠিপেটা করা হয়। তখন দীপ্তসহ অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় শকুনি লেকের পানিতে পড়ে যান। পানিতে পড়ে মৃত্যু হয় দীপ্তর। কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাদারীপুর প্রথম শহীদ হন দ্বীপ্ত দে।

ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো মা মনিকা দে বলেন, ‘সকালে ছেলে আমার হাতে মাখানো ভাত খেয়ে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় বললো,'বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসবে। এলো লাশ হয়ে! আমার ছেলে বাঁচার জন্য চিৎকার করেছে, কেউ ওরে বাঁচাতে আসে নাই। ছেলেটা পানিতে ডুবে অনেক কষ্ট পাইছে!'

তিনি আরও বলেন, 'দীপ্ত ঘরে থাকলে সব সময়ই বলতো, মা তুমি ভাত মেখে খাইয়ে দাও, মা এক কাপ চা করে দাও। ' কতদিন এই কথা শুনি না!'

বাবা স্বপন কুমার দে বলেন, ‘মাদারীপুরে প্রথম শহীদ হয়েছে আমার ছেলে। এটি ভাবতেই আমার বুক গর্বে ভরে যায়। ছেলে হারিয়েছি। কিন্তু বাহিরে গেলে যখন অনেকে দীপ্ত নাম উচ্চারণ করে তার সাহসিকতার প্রশংসা করে, তখন মনে হয় আমার ছেলের জীবন উৎসর্গ করাটা সার্থক হয়েছে। কিন্তু যখন বাসায় ফিরে আসি তখন চারিদিকে শুধু দীপ্তর শূন্যতা!

তিনি আরও বলেন, ‘যখন আমার ছেলেটা মারা যায়, তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘরি করে লাশ সৎকার করে ফেলতে হয়েছে। আমরা নিজে থেকে আর মামলাও করিনি। তবে শুনেছি একটি মামলা বাহিরে কেউ করেছে। যারা আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী শুনেছি সরকার তাদের বিচার করবে। যদি সেটা সরকার করতে পারে তাহলেই দীপ্তর আত্মা শান্তি পাবে। ’

তিনি বলেন, 'সরকারের কাছে অনুদান চাই না। এরপরেও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। জুলাই ফাউন্ডেশনের টাকা এখনো আমাদের দেওয়া হয়নি। শুনেছি ভোলা থেকে দেবে। এসব অনুদান পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া, যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মারা গেছে তাদের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। '

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।