ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

বিজয় মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আমির

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১:২৭, আগস্ট ৫, ২০২৫
বিজয় মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আমির স্ত্রী আর ছেলেদের সঙ্গে আমির

চাঁদপুর: রাজধানীর উত্তরায় একটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন গাড়িচালক আমির হোসেন (৩২)।  

গেল বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেখানকার লোকজনের সঙ্গে উত্তরা মডেল টাউন এলাকায় বিজয় মিছিলে যোগ দেন।

সেখানেই বুকে ও গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি।  

আমির হোসেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নের বড়গাঁও গ্রামের খোরশেদ আলমের ছেলে।

সম্প্রতি শহীদ আমিরের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে। বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। কবরের পাশেই খুঁটিতে লাগানো ছিল জাতীয় পতাকা। আমির হোসেন এলাকায় পরিচিত না হলেও শহীদ হওয়ার পর গ্রামের ছোট-বড় সবাই তাকে চেনেন।

কথা বলে জানা গেল, আমির হোসেনের বাবা খোরশেদ আলম (৫৮) এক সময় ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। করোনার সময় তিনি চাকরি হারিয়ে বাড়িতে চলে আসেন। এখন বাড়িতেই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

আমির হোসেনের মা রাহিমা বেগম (৫৫) গৃহিণী। তারা তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে আমির তৃতীয়।  

এক বোন মারাগেছে। সবার বড় আলমগীর (৩৬) ও মনির হোসেন (৩৪)। তারা চট্টগ্রাম রিয়াজ উদ্দিন বাজারে মাছের দোকানে কাজ করে। ৪ বোনের মধ্যে ছোট বোন মারাগেছে। বাকী রুবিনা (২৯) সালামা (২৬) ও ফেরদৌসির (২৪) বিয়ে হয়েছে।

আমির স্থানীয় বড়গাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।  

শহীদ আমির হোসেন নিজের পছন্দে বিয়ে করেন কর্মস্থল এলাকায় পরিচিত কুমিল্লা জেলার লাকসামের মেয়ে জেসমিন আক্তার রুপাকে। তাদের দুই ছেলে। বড় ছেলে ইয়াছিন (৪) ও ছোট ছেলে ইব্রাহীমের বয়স দেড় বছর।

শহীদ আমির হোসেনের শ্বশুর সাধু মিয়া অনেক বছর আগে মারা গেছেন, শাশুড়ি আয়শা বেগম (৫৫) গৃহিণী। আমির বাঁয়ে, ডানে বাবা-মা

গ্রামে আমিরের নিজের দুই চালা একটি ঘর থাকলেও স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে থাকতেন আব্দুল্লাপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে। আমির হোসেন উত্তরা মডেল টাউন ৪ নম্বর সেক্টরের ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে কাজ করতেন।

শহীদ আমিরের মা রাহিমা বেগম বলেন, ৫ আগস্টের কয়েকদিন আগে আমি ও আমার স্বামী চট্টগ্রামে বড় দুই ছেলের বাসায় বেড়াতে যাই। ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আমির হোসেন ফোন দেয়। আমাদের খোঁজ খবর নেয়। ফোনে আমাকে ছেলে বলছিল-মা ‘শেখ হাসিনাকে গদি থেকে নামিয়ে দিছে। আমিও যাই। ’ কোথায় যাই সে কথা বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারলাম ছেলে আমার বিজয় মিছিলে গিয়েছিল। এসব কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাহিমা বেগম।

তিনি বলেন, ছেলে আমার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। ছোট বেলা থেকেই সে ধার্মিক। গেল বছর ঈদুল আজহার পরে বড় নাতি ইয়াছিনকে নিয়ে বাড়িতে আসছিল। সময় পেলে বাড়িতে আসত আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সব সময় ফোন করে খোঁজ নিত আমাদের। তার বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় আমাদের সংসারের সব খরচই দিত আমার ছেলে। কেন আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হলো তার বিচার চাই। কীভাবে চলবে আমাদের অভাবের সংসার, সরকারের কাছে প্রশ্ন রাহিমা বেগমের।

আমির হোসেনের বাবা খোরশেদ আলম বলেন, ৫ আগস্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলে আমির। সন্ধ্যার পরে চট্টগ্রাম থেকেই জানতে পারি আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তার লাশ উত্তরা মডেল টাউন এলাকার মেডিকেল কলেজ ফর ওমেন অ্যান্ড হসপিটালে আছে। সেখান থেকে আমাকে ফোন করেন হাসপাতালের লোকজন। মডেল টাউন এলাকায় মিছিলে গেলে তার গলায় ও বুকে নয়টি গুলি লাগে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। তারপরও লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার দুই জামাতা জহিরুল ইসলাম ও হাবিব ঢাকায় থাকে। তারা হাসপাতালে গিয়ে লাশ নিয়ে জামাতা জহিরুল ইসলামের কর্মস্থল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে রাখে। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে বাড়িতে নিয়ে আসে লাশ। দুপুর ১২টার দিকে নামাজে জানাজা শেষে ছেলেকে দাফন করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর ছেলেও বউ বাড়িতে চলে আসে নাতিদের নিয়ে। পরে ঘটনাস্থল এলাকা থেকে ফোন আসে যাওয়ার জন্য। আমার স্ত্রী, ছেলের বউ ও নাতিদের নিয়ে আব্দুল্লাহপুরের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে ১৫ দিন ছিলাম। সেখানে জামায়াতের লোকজন দুই লাখ টাকা এবং অন্যান্য লোকজন অনুদানসহ তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা অনুদান দেন ছেলের বউকে। এরপর আমরা বাড়িতে চলে আসি। গ্রামেও ফরিদঞ্জ উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা করে। এরপর জেলা প্রশাসন ও জুলাই ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে ছেলের বউ।

ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড কোম্পানির প্রকৌশলী শাকিল আহমেদ ফোনে বলেন, আমির হোসেন আমাদের কোম্পানির গাড়িচালক ছিলেন। গেল বছর ৫ আগস্ট অফিস ছুটি ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন না। পরে অফিসে এসে অফিস বন্ধ দেখে এখান থেকে চলে যান। পরে বিকেলে শুনেছি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা কোম্পানির পক্ষ থেকে তার লাশ নেওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে দিয়েছি এবং দাফন-কাফনের খরচ দিয়েছি। সামনে চেষ্টা করছি, তাদের কিছু সহযোগিতা করতে, যাতে তার বাচ্চাদের উপকার হয়।

চালক শহীদ আমির হোসেনের স্ত্রী জেসমিন আক্তার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা কি নিয়ে বাঁচবো এখন। ছোট দুটো বাচ্চা। কী করে সামনে আমি তাদের খাওয়াবো পড়াবো, আমার স্বামী আমাকে এবং আমাদের সন্তানদের খুব ভালোবাসতো, কত স্বপ্ন ছিল বাচ্চাদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করবে, তা আর হলো না। সরকারি এবং মানুষের সাহায্য ছাড়া সামনে চলা একেবারেই অসম্ভব। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদেরকে সহযোগিতার আওতায় এনে চলার মত একটি পথ তৈরি করে দিতে। ঘরের ভিটা ছাড়া আর কোনো জমিও নেই স্বামীর।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।